সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্ক নিয়ে বরাবরই এদেশে আলোচনা আসে। সাংবাদিকেরা যারা রাজনৈতিক প্রতিবেদন করেন বা রাজনীতি নিয়ে লেখেন তারা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মেশেন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠাও স্বাভাবিক, কিন্তু কতখানি স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবেন তার একটি নিজস্ব দর্শন নিজের কাছেই রাখা চাই।
কথাগুলো এই কারণে উঠল যে, আজ ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ৫৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের মাঝে যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের মধ্যে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া অন্যতম।
তিনি তার শক্তিশালী রাজনৈতিক কলামে, সভা-সমিতিতে ভাষণ দানকালে যে বিষয়ের ওপর বারবার ইঙ্গিত দিতেন, তা ছিল পূর্ব বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন। প্রচণ্ড সাহসী এই মানুষ জানতেন, স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির মুক্তির পথ নেই। কিন্তু একই সাথে সাংবাদিক হিসেবে তার যে আলাদা সত্তা তা কখনো ভোলেননি।
মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীরা সেই সময় প্রমাণ করেছিলেন সাংবাদিকের কলম তরবারির চেয়েও পরাক্রান্ত হতে পারে। প্রখর বাক্যবাণে তারা পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের সমালোচনা করেছেন।
ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কলাম লিখতেন ‘মোসাফির’ ছদ্মনামে। ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গ-মঞ্চ’ ছিল তার সেই নিয়মিত কলামের শিরোনাম।
তার কলামের বিষয়বস্তু ছিল দেশ-বিদেশের সমকালীন প্রসঙ্গ। নির্ভীক সত্যকথন, অনন্য রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা আর গণমানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে তিনি সেই সময় পাঠকদের মন জয় করেছিলেন বলে আজও তিনি প্রাসঙ্গিক।
স্বাধীনতার আগে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গণ-আন্দোলনে সাংবাদিকদের ভূমিকা খুবই জরুরি ছিল, কারণ গণতন্ত্রের একটি মূল উপাদান সংবাদ। সেই সংগ্রামে মানিক মিয়া তথাকথিত নিরপেক্ষ ছিলেন না, তার ‘মোসাফির’ গণমানুষের পক্ষে কথা বলে গেছে আমৃত্যু।
গণতন্ত্রের মানসপুত্র খ্যাত এই দেশের অন্যতম মহান জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন মানিক মিয়া। তার মাধ্যমেই পিরোজপুরের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় যাওয়া, যেখানে প্রথমে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি (১৯৪৫) পদ নেওয়া এবং পরবর্তীতে আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেহাদ-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি (১৯৪৬-৪৮) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মাধ্যমে ঠিক হয়ে গিয়েছিল তার জীবনের গতিপথ।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল মনসুর আহমেদের মতো ব্যক্তিদের সাহচর্যে রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় তার যে হাতেখড়ি তা পরবর্তী জীবনে সাংবাদিকের জায়গা থেকে রাজনীতিকে প্রভাবিত করার কাজটি করেছেন আজীবন।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির পেছনে ইত্তেফাক সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল বলা হয়। আর এক্ষেত্রে তার কলামগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কেবল কলাম নয় সামরিক আইন ভাঙা, ঐতিহাসিক ৬-দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ইত্তেফাকে সেই বিষয়ে বক্তব্য-বিবৃতি প্রকাশ করায় একাধিকবার তাকে কারাভোগও করতে হয়েছে। কিন্তু তার দৃঢ়চিত্তের অবস্থান ছিল সবসময়ই আপসহীন।
বঙ্গবন্ধু ও মানিক মিয়া ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দুই নিবেদিতপ্রাণ ঘনিষ্ঠ সহচর। বলা হয়ে থাকে, এরা দুইজন তার হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে অসি ও মসির ভূমিকা পালন করে আসছিলেন।
বছর কয়েক আগে এক আলোচনা সভায় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেছিলেন, ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জেল থেকে বেরোনোর পর যখন চিকিৎসার জন্য চলে যাচ্ছিলেন, তখন মুক্তিকামী যুব সমাজ তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি চলে যাচ্ছেন, আমাদের কী হবে? জবাবে সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, আমি দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। একটি হলো মাঠ, অপরটি হলো কলম, মাঠের দায়িত্ব মুজিবের, আর কলমের দায়িত্ব মানিক মিয়ার। এই দুটো জিনিস যেন বিচ্ছিন্ন না হয়। দুটো এক থাকলে আন্দোলন সফল হবেই।’ (মাঠ দেখেছেন বঙ্গবন্ধু, কলমের দায়িত্বে ছিলেন মানিক মিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক, ২ জুন, ২০১৬)
এই দুজনের রসায়ন ছিল অসাধারণ। স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া।
একদিকে বঙ্গবন্ধু যেমন সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে পথনির্দেশ করেছেন, অন্যদিকে মানিক মিয়া দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, '৬২-এর ছাত্র ও সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, '৬৫-এর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, '৬৬-এর ছয় দফা ও স্বায়ত্তশাসন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে লেখনীর দ্বারা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
তিনি রাজনীতিবিদ না হলেও আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ। বঙ্গবন্ধু তাকে 'মানিক ভাই' বলে সম্বোধন করতেন। তার পরামর্শ বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতেন। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সেই সম্পর্ক ছিল অটুট।
মানিক মিয়া ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুসারী। শোষণ ও নিপীড়ন থেকে গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন মানিক মিয়া। উপমহাদেশের দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তার মানবিক বোধের উন্মেষ ঘটায়।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হলে তিনি দাঙ্গা প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার দেওয়া ব্যানার হেডিং ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ আজও মানুষ মনে রেখেছে।
স্পষ্টতই এদেশের স্বাধীনতার জন্য জনমত গঠনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের চেয়ে মানিক মিয়ার মতো অকুতোভয় ও আত্মোৎসর্গীকৃত কলম সৈনিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় যে প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছিল, সেটাই ছিল মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের চালিকা শক্তি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, যদিও মানিক মিয়ার তা দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।
যে স্বপ্ন নিয়ে মানিক মিয়ার মতো মহতী ব্যক্তিত্বরা তাদের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, তা কতটুকু অর্জিত হয়েছে? দেশে আজ সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিপুল সমাহার, কিন্তু মানিক মিয়া জেল-জুলুম আর প্রলোভনকে নস্যি করে নির্ভীক, আপসহীন, গণমুখী সাংবাদিকতার নজির আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
শুধু রাজনীতি নয়, সাংবাদিকতা নিয়ে ভাবতেন মানিক মিয়া। মূলত সাংবাদিকতাকে যতটা না তিনি জীবিকা বা পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি নিয়েছিলেন গণমানুষের পক্ষে কথা বলবার একটি উপায় হিসেবে। তাই, আমরা দেখি, যুক্তফ্রন্ট সরকারে মন্ত্রিত্বের অফার তাকে আকর্ষণ করেনি।
স্বৈরশাসকদের জেল-জুলুম কিংবা প্রলোভন- কোনোটাই তাকে গণতন্ত্র ও গণমানুষের অধিকারের পক্ষে তিনি যে কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তা থেকে এতটুকু টলাতে পারেনি।
ষাটের দশকে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে মানিক মিয়া বলেছিলেন, ‘সংবাদপত্র ব্যক্তি বিশেষের মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হইলেও জনমতের প্রতিধ্বনি না করিলে সে পত্রিকা টিকিয়া থাকিতে পারে না, ইহা অন্যান্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির ন্যায় ব্যবহার করা চলে না।’ স্বাধীন গণমাধ্যমের পক্ষে কোন পত্রিকা মালিকের এমন কণ্ঠস্বর আজ আর শোনা যায় না।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন
লেখাটি ঢাকা পোস্ট হতে নেওয়া।