তার বিশ্বাস ছিল ব্যক্তির মর্যাদা গণতন্ত্রের মর্মকথা

স্মরণ

এহসানুল কবির

(১ মাস আগে) ৯ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার, ৩:৫০ অপরাহ্ন

talktrain

মরহুম মইনুল হোসেন

মরহুম মইনুল হোসেন বিগত সরকারের ‘উন্নয়নের গণতন্ত্রের’ স্লোগানের একজন কড়া সমালোচক ছিলেন। তিনি বলতেন, গণতন্ত্রের পেছনে যখন কোনো বিশেষণ যুক্ত হয়েছে তখন ওটি আর নির্ভেজাল থাকেনি, ভেজালতন্ত্রের ফলে খোদ গণতন্ত্রেরই মৃত্যু ঘটেছে। একদল লোক ক্ষমতায় যাওয়ার আগে সাপের মন্ত্র পড়ার মতো গণতন্ত্র, গণতন্ত্র বলে চিৎকার করেছে। শিক্ষার মর্মবাণী ও মানব বিদ্যাবিবর্জিত এই নেতা-নেত্রীরা ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতির বারোটা বাজিয়ে এক সময় বিদায় নিয়েছে। আজ অন্তর্দৃষ্টি, পরিজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। নিকট অতীতে অল্পজ্ঞানী, অদূরদর্শী, রুচিহীন, শিষ্টাচারবহির্ভূত, শিক্ষা ও ধর্মের মর্মকথার প্রতি বিতৃষ্ণ একদল জাঁকজমকপূর্ণ লোক রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, শিক্ষাঙ্গন থেকে ক্রীড়াঙ্গন- সবখানেই জেঁকে বসেছিল। তাদের কারণে কোনো মহৎ কাজ প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছিল না। এর ফলে কোনো উন্নত দর্শন, কালচার বা উন্নত শিক্ষার সৃষ্টি হয়নি; বরং সৃষ্টি হয়েছে লালসার, মোসাহেবি পরশ্রীকাতরতা আর অপ্রকাশ্য গূঢ় মনোবাঞ্ছার কদর্যতা। এগুলোর চারণভূমি হয়ে উঠল বাংলাদেশ।

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দেশবাসীর কাছে নতুনভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন ১৯৭৩ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পরে। বিলেতফেরত এই ব্যারিস্টার বিলেতে গণতন্ত্র, সেখানকার শাসনব্যবস্থা ও পার্লামেন্ট দেখে এসেছেন। তিনি চাইলেন উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ ইংল্যান্ডের মতো যদি সম্পূর্ণ সম্ভব নাও হয় তার পরও তাদের চেতনাবোধ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আমাদের অনুসরণ করতে অসুবিধা কোথায়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গণতন্ত্রের পরাজয় নয়। কিন্তু বিধিবাম, একা মইনুল হোসেন বা ব্যারিস্টর আমিরুল ইসলাম- এদের পক্ষে পার্লামেন্টের গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হলো না। খোদ সরকারপ্রধান (Leader of the house) তখন বক্তব্য রাখছেন বিরোধী দলের নেতার মতো। কী পার্লামেন্টের ভেতরে, কী বাইরে- তিনি বক্তব্য রাখছেন যেন তখনো তিনি আইয়ুবের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। মেধাশূন্যদের শাসন, নেতৃত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্যতা সেই স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে যেন এ জাতির জন্য কাল হয়ে দেখা দিলো। জাতীয় অধ্যাপক আর রাজ্জাক বলতেন, ‘ইতিহাস শেখ সাহেবকে একটি Statesman হইবার সুযোগ দিছিল, তিনি সেইডারে কাজে লাগাইতে পারলেন না।’ অন্য দিকে মইনুল হোসেন ছিলেন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণ-অধিকারের ঘোরতর সমর্থক ও সোচ্চার কণ্ঠ। তার পরও তিনি তার কাকাকে (শেখ মুজিবুর রহমান) গণতন্ত্রের পথে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি হয়েছিলেন তার সুশিক্ষিত উপদেষ্টাদের বৌদ্ধিক ঔদ্ধত্যের শিকার। তিনি রাজনীতি শুরু করেন গণতন্ত্রের কথা বলে আর মৃত্যুবরণ করেন একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে।

এখন প্রশ্ন আসবে, রাজনীতি ও জীবনগাথার কাহিনীতে এই করুণ ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হলো কিভাবে। এই প্রশ্নের উত্তরে মরহুম মইনুল হোসেন আমাদের বলেছেন, তার সব কিছু বোধগম্য ছিল না। তিনি বলেছেন, কোথায় যেন গণ্ডগোলের একটি জট পাকিয়ে ছিল, যা ছিল তার জানার বাইরে। মইনুল হোসেন লিখেছেন, তাকে (শেখ মুজিবুর রহমানকে) রক্ষা করতে না পারা আমাদের চরম ব্যর্থতা।
তিনি লিখেছেন, এ সময় ভারত থেকে বড় বড় কর্মকর্তা যারা বাংলাদেশে আসতেন তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানের প্রতি অনুরক্ত ব্যক্তিদের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিতেন এবং এ জন্য শাসনব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তনের প্রতি ইঙ্গিত দিতেন।
একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ব্যাপারে মইনুল হোসেনের ব্যাপক ধারণা থাকা সম্ভব ছিল না, কেননা তিনি সব সময় ছিলেন গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির সমর্থক। এ ব্যাপারে বিশদ যিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি ‘ইতিহাসের রক্তপলাশ’ গ্রন্থের লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী। গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা ও মিসরের মতো সব পত্রিকা জাতীয়করণের একটি প্রস্তাব তার (শেখ মুজিব) মাথায় আসে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের আগে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্যও একধরনের বাণী তাকে শোনানো হয়, বোঝানো হয়। গাফ্ফার চৌধুরী আরো লিখেছেন, ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে দেশের সংবিধান ও প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য তিনি গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করছিলেন।

১৯৭৪ মালের ১৮ মে দিল্লিতে মুজিব-ইন্দিরা এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে মিসেস গান্ধী শেখ মুজিবকে প্রশাসনিক গণতন্ত্র চালুর ইঙ্গিত দেন। এ সময় জয় প্রকাশের নেতৃত্বে সারা ভারতে রেল এবং ডাক-তার সেক্টরে সর্বাত্মক ধর্মঘট চলছিল। ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ভারতে এ জরুরি অবস্থার দিনটিকে আজও প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ সময়েই মুজিবের সফরকালে তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) এ-ও বলেছিলেন, কিছ ুদিনের জন্য তিনি কঠোর হতে চান গণতান্ত্রিক কিছু ব্যবস্থা তিনি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও বাতিল করতে চান। গাফ্ফার চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে জানতে চান, মিসেস গান্ধীর প্রস্তাবে... তার সমর্থন আছে কি না। উত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমি সব সময় বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েছি। ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বার্থেই মিসেস গান্ধীকেও কিছু দিনের জন্য প্রশাসনিক গণতন্ত্রকে কাটছাঁট করতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য এমন কোনো চিন্তাভাবনা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে কি না গাফ্ফার চৌধুরীর এমন প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব জানিয়েছিলেন, আমি অবশ্য সব ধরনের একনায়কতন্ত্রের বিরোধী। কিন্তু রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি বলেও একটি কথা আছে। যদি দরকার হয় কিছু দিনের জন্য রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারা মিলিটারি ফ্যাসিজমের অভিশাপ রুখতে হবে। গাফ্ফার চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, এতটা স্পষ্টভাবে ও গুছিয়ে তিনি কখনো আগে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা আমার কাছে প্রকাশ করেননি।

এ প্রসঙ্গে একজন বিদেশী লেখক বলেছেন, গণতন্ত্র ও ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে যার সামান্যতম আগ্রহ আছে Man of the People-এর এ ধরনের চিন্তাধারা থাকাটা বিপজ্জনক। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে- মুজিবের বাকশালে যতটা না কমিউনিস্ট ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল করপোরেটিস্ট যাকে প্রায় ফ্যাসিবাদী বলা যেতে পারে। জীবনে তিনি কখনো মার্কস, লেনিন বা মাও সেতুংয়ের বই হাতে তুলে নেননি অথচ একটি শূন্যগর্ভ মতাদর্শকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিলেন। এতে করে মনে হয় মুজিবের সরকার সম্পর্কিত ধারণার সাথে নেহরুর কংগ্রেসের চেয়ে সঞ্জয় গান্ধীর কংগ্রেসের মিল ছিল বেশি। মইনুল হোসেন লিখেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমেই যেটি চোখে পড়ল তা হলো- রেডিও ও টেলিভিশনে কুরআন শরিফ পড়া বন্ধ হয়ে গেল। আমি বিষয়টি নিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের সাথে কথা বললে তিনি বললেন, যার যেটি মনে আসছে সেভাবেই সব কিছু চালাতে চাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু এলে বোঝা যাবে। কাকা ফিরে এলে রেডিও ও টেলিভিশনে কুরআন পড়া আবার শুরু হলো।

এ সময় মোজাফফর ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির হম্বিতম্বি ভাব ক্রমেই বাড়তে থাকল। ভাবটা এরকম- তাদের জন্য ভারত যুদ্ধে সাহায্য দিয়েছে, তাদের জন্য দেশ স্বাধীন হয়েছে। এ দল দুটোর কোনো জনভিত্তি ছিল না। অথচ তাদের মুরুব্বিয়ানা মেনে নিতে হবে।
কাকা প্রথম দিকে তাদের চাপ অগ্রাহ্য করে চলছিলেন। মণি সিংহয়ের ব্যাপারে তার কোনো উচ্চ ধারণা ছিল না। তাকে সিংওয়ালা মানুষ বলতে শুনেছি। গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন- মণি সিংহকে জাতীয় কৃষক লীগের সাত নম্বর সদস্য করা হয়েছিল। এর পরও আমরা তাকে রক্ষা করতে পারলাম না। ১৫ আগস্টকে শুধু কলঙ্কের ব্যাপার বলাই যথেষ্ট নয়, তাকে রক্ষা করতে না পারা আমাদের চরম ব্যর্থতাও।

এরপর মরহুম মইনুল হোসেন লিখেছেন, ১৯৭৩ সালে আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই। আমি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার দুই বছরের মাথায় সংসদীয় গণতন্ত্র বিলুপ্তির ঘটনা দেখলাম। জেনারেল এম এ জি ওসমানী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, আবদুল্লাহ সরকার (জাসদ), ময়নুদ্দিন মানিক (জাসদ) সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু কেন বাকশাল করলেন, এ প্রশ্নে মরহুম মইনুল হোসেন লিখেছেন, এক দিন তখনকার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান আমার বাসায় এসে হাজির এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে হবে এই বলে আমাকে নিয়ে যান। পথে নজরুল ইসলাম সাহেবের অফিস হয়ে দু’জনই গণভবনে পৌঁছালাম। এরপর আমাকে তিনি কাকার কাছে রেখে কেটে পড়লেন। তখন কাকার চোখে ‘জল’ ছলছল করছিল। তিনি অত্যন্ত আবেগের সাথে বললেন, আমি মানিক ভাইয়ের সাথে কত ঝগড়া করেছি, এখন তোরা আমার সাথে ঝগড়া করবি। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল তাকে জড়িয়ে ধরে বলি, সে সম্পর্কের কথা জানি বলেই আপনার নিরাপত্তা সম্পর্কে এত চিন্তিত। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন; কাকা আব্বার অবর্তমানে আপনাকে আব্বা হিসেবে জানি। আজকে আপনার স্থলে আব্বা থাকলে তাকেও বলতাম বাকশাল না করার জন্য। তখন আমার চোখেও ‘জল’ এসে যায়। এক পর্যায়ে আমি তাকে বললাম, একনায়কতন্ত্র কায়েম হলে আপনি একাই টার্গেট হবেন। ‘টার্গেট’ শব্দটি আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। তিনি আর কথা বাড়ালেন না। এখন মনে হয় আমার উচিত ছিল বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করা। তার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র আমি অনুভব করছিলাম। মইনুল হোসেন লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত দেশী-বিদেশী পরামর্শে কঠিন সমস্যার সমাধানে সহজ পথ বেছে নিলেন।

মরহুম মইনুল হোসেন মনে করতেন, গণতান্ত্রিক সমাজই রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্ণতা অর্জন করে। রাষ্ট্র কোনো বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নয়। রাষ্ট্রকে পুরো সমাজের স্বার্থ সংরক্ষক হিসেবে দেখা হয়। আজকের চীন-রাশিয়াকে কোনো বিশেষ শ্রেণীর রাষ্ট্র বলে বিবেচনা করার কোনো কারণ নেই। গণতন্ত্র ও মানুষ সম্পর্কে তিনি ছিলেন আশাবাদী। তিনি মনে করতেন, গণতন্ত্রে প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ। যিনি সমাজের যে অবস্থানে রয়েছেন সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবেন। তাই বলা হয়- ব্যক্তির মর্যাদাবোধ হচ্ছে গণতন্ত্রের মর্মকথা। ব্যক্তি মাত্রই যুক্তিবোধ আছে, তাকে নির্বোধ মনে না করাটাই গণতন্ত্র। আর নির্বোধ মনে করার অর্থ হলো- সরকারের উপর তার নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করা। মইনুল হোসেন মনে-প্রাণে এই বিশ্বাসকে ধারণ করে গেছেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিক

লেখাটি দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত।