
আতাউস সামাদ একজন ডাকসাইটে সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিকতা করা বা করানো অথবা তথ্যবিদ্যা পড়ানোর শানে-মানে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য– এমন মূল্যায়নে তাঁকে দেখা স্রেফ উপেক্ষারই নামান্তর। প্রেস বা সংবাদক্ষেত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে দেশ পরিচালকেরা বরাবর অনীহামূলক স্বীকৃতি দেন। তেমনি সমাজে একজন কিংবদন্তি সাংবাদিককে মান্যতা দিতেও তারা পশ্চাৎপদ থাকেন। তাতে কি ওই সাংবাদিকের কীর্তি বা সুনাম বাতিল হয়ে গেল? আজকে তাঁর দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে সেই আলোচনাটাই করতে চাই।
বস্তুত আতাউস সামাদ ছিলেন একজন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। দেশ ও মানুষ অন্তপ্রাণ। ভারতের মারাঠি কবি বিশরণ কুমার লিম্বালি’র পঙ্ক্তিতে এমন চরিত্রের দেখা পাই– “চাই না আমি তোমাদের আকাশ থেকে সূর্য আর চাঁদ/ তোমাদের জমি-জমা, খেত-খামার/ তোমাদের প্রাসাদগুলি....../ বা এমনকি তোমরা যে ভালোবাসা পাও মা-বোন-মেয়ের কাছ থেকে/ চাই না তা-ও/ আমি শুধু চাই মানুষের অধিকার/”।
মানুষের অধিকার, রাষ্ট্রের মুক্তির জন্য লেখালেখি এবং কিছু একটা করার তাগিদ সর্বদাই তাঁর মনস্তত্ত্বে ব্যাপক গভীরভাবে ছিল। মানবাধিকারের জন্য মিডিয়া ও রাজপথে সমান সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯৪-৯৫তে রাজনৈতিক সংকটকালে মধ্যস্থতার জন্য পাঁচ বুদ্ধিজীবী কমিটির সদস্য ছিলেন।
উইলিয়াম শেকসপিয়রের ‘হ্যামলেট’ থেকে ‘টু বি অর নট টু বি: দ্যাট ইজ দ্য কোশ্চেন’ সংলাপ অবলম্বনে ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল সম্পর্কে সংজ্ঞা টেনেছিলেন এভাবে– ‘আপনি প্রশ্ন করবেন কি করবেন না: প্রশ্ন সেটাই’। এই শিরোনামে তাঁর একটি বহুল আলোচিত নিবন্ধও রয়েছে।
রমিলা থাপারের সংজ্ঞাটি আতাউস সামাদের মতো সাংবাদিকদের জন্যই প্রযোজ্য। ওইসব মানুষ নিরুচ্চার থাকতে পারেন না। সমাজের কমফোর্ট জোনে থাকতে চান না। প্রশ্ন তুলবেন; ক্ষমতার মোহন বৃত্তের বাইরে স্বাধীনভাবে মত জানাবেন; মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিবেক দিয়ে সামাজিক বিচারের দাবিতে সাধারণ মানুষকে সমর্থন করবেন। পবিত্র কোরআনে সুরা নিসার ১৩৫ আয়াতে আল্লাহ জ্ঞানীদের সতর্ক করেছেন এভাবে– ‘ন্যায় প্রতিষ্ঠায় যদি তোমরা পেঁচালো কথা বলো অথবা পাশ কাটিয়ে যাও তবে মনে রেখো, তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত’।
আতাউস সামাদের অন্তর্বোধে একটা আগুন ছিল। হতাশা তো বটেই। তাঁর ‘একালের বয়ান’ বইয়ে কষ্টের উল্লেখটা পরিষ্কার পাওয়া যায়– ‘জীবনের এতোটা পথ হাঁটলাম, কিন্তু আলোর দেখা পেলাম না। কবে দেখব দেশকে উদ্ভাসিত আলোয়? সময় তো নিষ্ঠুর, কাউকে রেয়াত করে না।’ কেন লেখেন– এমন প্রশ্নে বাংলা ভাষার কালজয়ী ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, স্বাধীনতার একত্রিশ বছরেও আমি অন্ন, জল, জমি, ঋণ বেঠবেগারী– কোনটি থেকে মানুষকে মুক্তি পেতে দেখলাম না। তার বিরুদ্ধে নিরঞ্জন, শুভ্র ও সূর্য- সমান ক্রোধই আমার সকল লেখার প্রেরণা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে আমার মতো অনেক ছাত্র ছিল আতাউস সামাদের। তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়াতেন রিপোর্টিং। বক্তৃতায় রিপোর্টারের অভিজ্ঞতা ও বিদ্যার চমৎকার অন্বয়। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে মাস্টার্স পাস করা। তিনি এক রকম জীবন-শিক্ষকও ছিলেন। এখনও আমরা লিখতে এবং বলতে অনুভব করি আতাউস সামাদের বড় বড় দুটি চোখে প্রশ্নময় দৃষ্টি। এই বুঝি তাঁর ফোন এলো! সর্ববিষয়ে শিশুর মতো অক্লান্ত কৌতূহল, অবিরত জিজ্ঞাসা ও তর্ক এবং তথ্যের ন্যায্যতা দিয়ে খবর বা বিশ্লেষণ দাঁড় করানো ছিল তাঁর ধর্ম। বাংলাদেশের সকল শাসকই এই ‘গোলমেলে’ লোকটাকে সমীহ করতেন ধড়ফড় বুকে।
বেশি দিন আগের কথা নয়। সাংবাদিকতা করতে গেলে পড়তে হবে; ফাইভ ডব্লিউ’স দিয়ে রিপোর্টের গড়ন বানাতে হবে– এমন ধারণা যখন সাংবাদিক সমাজেই পাগলের কাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতো অথবা তিনি সাংবাদিকতা পইড়া আইছেন– এমন টিপ্পনী যখন আমাদের নিত্য সইতে হয়েছে, ওই সময় আমাদের সাহস দিয়েছেন আতাউস সামাদ, হাসান সাঈদ, শহীদুল হক, আহমেদ হুমায়ুন, নজরুল ইসলাম, এসএমএ চৌধুরীর মতো দিকপাল সাংবাদিক ও খণ্ডকালীন শিক্ষকেরা। সঙ্গে তো ছিলেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকবৃন্দ নূরুদ্দীন, সাখাওয়াত আলী খান, তৌহিদুল আনোয়ার, শামসুল মজিদ হারুণ, আবদুল মান্নান এবং ওয়াজির হোসাইনেরা।
আতাউস সামাদ পারিবারিকভাবে, শিক্ষাগতভাবে, চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে সৎ আলোকিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই প্রতিনিধি ছিলেন। ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ নন। যারা তদানীন্তন পূর্ব বাংলার সাহিত্য ও সাংবাদিকতার স্বকীয়তা ধরে রেখে পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। ১৯৭০-এ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্লোগান দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং যখনই সরকার স্বৈরাচার হয়েছে; সাংবাদিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে রুখে দাঁড়ানোর ঘটনাবলিতে তিনি অবিস্মরণীয়। শেখ হাসিনার কুশাসনকালে তাঁকে পড়তে হয়েছে রোষানলে; এরশাদের আমলে জেল খেটেছেন। তিনি ও বিবিসি একাত্মা হয়ে গিয়েছিল।
‘স্টাইল ইজ দ্য ম্যান’– এই চমকপ্রদ সত্যটা অনেক আগের। স্টাইল একজন লেখক-সাংবাদিকের নির্বাচিত প্রণালি, তাঁর প্রক্ষেপণ পদ্ধতির মনোনীত স্বর। আতাউস সামাদ অমন ভিন্নতা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। প্রচলিত ধারণায় একজন সাংবাদিক মানে দুঃসাহসী। আতাউস সামাদ তা দেখিয়ে গেছেন বিবিসির রিপোর্টিংয়ে। স্বৈরাচারী এরশাদ যেদিন মতিঝিলে বিসিসিআই ভবন পরিদর্শনে গেলেন, সেদিন ওই সংস্থার কর্মচারীরা তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছিলেন। আতাউস সামাদ জাতিকে সে খবর জানিয়ে জেলে গেলেন।
নামি সাংবাদিক মানে যদি হয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর সাক্ষী থেকে রিপোর্ট করার সক্ষমতা, তাহলে বুঝতে হবে, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দিল্লি থেকে শেখ মুজিবের দেশে ফেরার ফ্লাইটে তিনি একমাত্র সাংবাদিক সহযাত্রী ছিলেন। রিভিলিং রিপোর্ট যদি হয় একজন প্রশংসিত সাংবাদিকের মাপকাঠি, তাহলে ভুলতে পারি না ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার খবরটি আতাউস সামাদই প্রথম দিতে পেরেছিলেন। শুধু কি লেখালেখি? দুঃসময়ে ‘দৈনিক আমার দেশ’ ও এনটিভিকে সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আতাউস সামাদ কখনও বিত্তের দিকে তাকাননি। পৈতৃক সম্পত্তিই ছিল ভরসা। রেণু ভাবির সদা সাহচর্য এবং ছেলে সন্তু, মেয়ে সাথী ও শান্তার চমৎকার শ্রদ্ধা তাঁর জীবনের সাফল্যের অন্যতম দিক। ভাবি মারা গেলেন স্যারের মৃত্যুর পর। এখন পরিবার বিদেশে।
আসলে, দেশই তাঁর সন্তানকে মনে রাখে।
শওকত মাহমুদ: সাংবাদিক ও রাজনীতিক
২৬ সেপ্টেম্বর সমকালে প্রকাশিত।