
নিউ এইজ পত্রিকাকে দেওয়া অধ্যাপক ইউনুসের সাক্ষাৎকারটি ভালো লাগার পেছনে যে কয়েকটি কারণ তার একটি হচ্ছে সম্পাদক নুরুল কবীর প্রধান উপদেষ্টাকে তাদের নিজেদের লোক বলে বিবেচনা করেন নি। যে কোনও সাক্ষাৎকার উৎকৃষ্ট হয়ে ওঠার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিকের প্রথম কাজ হচ্ছে তিনি যার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তাঁকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা। অর্থাৎ তাঁকে সাংবাদিকের পক্ষের বা বিপক্ষের লোক হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এরকম একটা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সাক্ষাৎকার নিতে হবে।
দ্বিতীয় কারণ- মানুষের মনের ভেতরে যেসব প্রশ্ন সেগুলো জিজ্ঞেস করতে হবে। কেননা তাদের প্রতিনিধি হিসেবেই তিনি তার সাক্ষাৎকার নিতে গেছেন। সাংবাদিক এখানে পাঠক ও দর্শকের প্রতিনিধি। তারা যে প্রশ্নটির উত্তর জানতে চান সেটাই বের করে আনতে হবে কারণ তাদের সুযোগ নেই প্রধান উপদেষ্টাকে এই প্রশ্ন করার।
এছাড়াও প্রশ্নগুলো ছিলো চাছা-ছোলা, তীক্ষ ও শক্তিশালী। প্রশ্ন করতে গিয়ে এটা ভাবলে চলবে না যে তিনি কী মনে করবেন। যখনই তাঁকে খুশি করার জন্যে অথবা তাঁকে দুঃখিত করার জন্য, অর্থাৎ এধরনের কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রশ্ন করা হবে, তখনই ওই সাক্ষাৎকারের মৃত্যু ঘটবে।
একই সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তাঁকে ভয় পেলেও চলবে না। এটা ভাবা যাবে না- এই প্রশ্ন করলে তিনি যদি আমাকে তার বিপক্ষের লোক মনে করেন, যদি তিনি ক্রুদ্ধ হন, তাহলে আমার কী হবে। এরকম ভয় নিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তাঁকে প্রশ্ন করাই সম্ভব হবে না। সুতরাং যে প্রশ্নটি যথার্থ সেটা নির্ভয়ে ছুড়ে দিতে হবে।
সম্পাদক নুরুল কবির সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তিনি শুধু কী প্রশ্ন করবেন সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না, প্রধান উপদেষ্টার উত্তরগুলোও তিনি খুব মনযোগ দিয়ে শুনেছেন। এবং শুনতে শুনতে যখনই যে সম্পূরক প্রশ্নটা মাথায় এসেছে সেটা করেছেন, যে কারণে সাক্ষাৎকার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেছে।
আর যেটা প্রয়োজন তা হচ্ছে যে বিষয়ে সাক্ষাৎকার নিচ্ছি সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। সাংবাদিককে ওই বিষয়ে পণ্ডিত হতে হবে না, তবে ওই বিষয়ে ঘটনাবলী, কার্য কারণ ইত্যাদি বিষয়ে একটা ধারণা থাকা অপরিহার্য।
তবে সাক্ষাৎকারদাতাকে জ্ঞান দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে যে আমি বলতে নয়, শুনতে এসেছি। আমার যে জ্ঞান বা তথ্য আছে সেটা তাঁকে বলার জন্য নয়, সেটা প্রয়োজন তার সঙ্গে কথা বলার জন্য।
আরও দুটো বিষয় জরুরি: সাক্ষাৎকারদাতাকে কখনও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যাবে না, তার সঙ্গে উত্তেজিত হওয়া যাবে না, তাঁকে খাটো করার চেষ্টা করা যাবে না এবং তাঁকে আক্রমণ করা তো যাবেই না।
সবশেষে যে কথাটা না বললেই নয়: সম্পাদকের প্রশ্ন যেমন তীক্ষ্ন ছিলো তেমনি স্বচ্ছ, পরিষ্কার, সৎ এবং টু দ্য পয়েন্ট উত্তর ছিল প্রধান উপদেষ্টার। যেটা তিনি জানেন না সেটা অকপটে ও সাবলীলভাবে স্বীকার করেছেন। একজন ব্যক্তি তো সব জানে না, জানা সম্ভবও নয়। কেউ যদি সেটা স্বীকার করেন তাহলে তার মহত্ত্বই প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফেসবুকে দেখলাম কেউ কেউ প্রধান উপদেষ্টার এসংক্রান্ত উত্তরগুলো নিয়ে হাসি তামাশা করছেন। তাদেরকে বলতে চাই- শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করা লাগতো না, তিনি দুনিয়ার সবকিছু জানতেন। রান্না থেকে শুরু করে বিজ্ঞান কোনো কিছুই বাকি ছিলো না। এবং সব প্রশ্নের উত্তর তিনি সেই একটা জায়গা থেকেই শুরু করতেন। আর সবশেষে তাদেরকে মনে করিয়ে দেই- প্রধান উপদেষ্টাকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছে, কোনও সাংবাদিককে কি কখনও শেখ হাসিনাকে এরকম প্রশ্ন করতে দেখেছেন? পেছন ফিরে গণভবনের দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন!
মিজানুর রহমান খান, সাংবাদিক, বিবিসি
(লেখকের ফেসবুক পোস্ট হতে নেওয়া।- মুক্তবাক)