www.muktobak.com

স্মৃতিতে অম্লান এনামুল হক খোকন


 হীরক গুন    ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১:১৪    স্মরণীয়


সদা হাস্যজ্জল,  নির্ভিক, সৎ নিষ্ঠাবান  একজন সাংবাদিক এনামুল হক খোকন। বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায়। যিনি কর্মরত ছিলেন দৈনিক প্রথম আলোর সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি হিসেবে। ২০০৪  সালে তিনি সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন প্রথম আলোতে।

এর আগে  শাহজাদপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। খোকন ভাই জেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে নিয়োগ ছাড়াই কিছুদিন প্রথম আলো পত্রিকায় আমার  কাজ করার সুযোগ হয়। সেই সুবাদে খোকন ভাইয়ের সাথে মেশার সুযোগ হয়। যদিও আগে থেকেই পরিচয় ছিল এই মানুষটির সাথে।

জেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কারনে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন তিনি আসতেন সিরাজগঞ্জ জেলা সদরে। এর পর পত্রিকার কাজের জন্য পরিবারের মায়া ত্যাগ করে  প্রথমে স্থায়ী ভাবে বসবাস আর অফিস শুরু করেন সিরাজগঞ্জের সিরাজী সড়কে । সেই থেকে খোকন ভাইয়ের অফিসে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমার।

সুযোগ হলো  খুব কাছ  থেকে তাক দেখার। আমার মতো অনেক সাংবাদিকেরই যাতায়াত ছিল খোকন ভাইয়ের অফিসে। দেখতাম মাঝে মধ্যে চাপ কম থাকলে পত্রিকার কাজ শেষ করে রাতেই মটরসাইকেল অথবা বাসে চেপে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পরিবারের কাছে ছুটে  যেতেন মধ্য বয়সী এই মানুষ। তার পর সকাল হলেই আবার ছুটে আসতেন নিজ কর্মস্থলে। তার মধ্যে ক্লান্তি দেখিনি কখনো ।

আস্তে আস্তে নিজ কাজের দক্ষতায় খোকন ভাই সিরাজগঞ্জের সাংবাদিক আর সব শ্রেনী পেশার মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠলেন। সবার কাছে হয়ে উঠলেন খোকন ভাই। সাংবাদিতার পাশাপাশি রোটারি ক্লাব, জ্ঞানদায়িনী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি, দূর্নীতি   প্রতিরোধ কমিটিসহ সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েন।

পরিবারে স্বচ্ছলতা থাকলেও সাংবাদিকতা পেশাটাই তাকে বেশি টানত। এর পর এস এস রোডে আমার অফিসের সাথেই খোকন ভাই তার অফিস ভাড়া নেন। আর সেখানেই তার ছিল বসবাস।  বয়সে বড় হলেও আমার সাথে ছিল খুব মধুর সম্পর্ক। সাংবাদিকরা কোন কাজে শাহজাদপুরে গেলে  দুপুরে খাওয়া হতো খোকন ভাইয়ের বাসায়।

রির্পোটিংয়ের বিষয়ে  কতই না আড্ডা দিতাম ভাইয়ের সাথে। প্রায় সময় বিভিন্ন নিউজ বিষয়ে অনেক পরামর্শ নিতাম। তিনিও চাইতেন নতুন নতুন রির্পোটের আইডিয়া। দেখেছি তরুন সাংবাদিকদের স্নেহ ভালবাসার পাশাপাশি কাজের অনুপ্রেরণা দিতে। সবার সাথে মিশতেন সমান ভাবে। মাঝে মধ্যেই রাগ করে বলতাম, খোকন ভাই বয়স হয়েছে এখন  রাত করে মটরসাইকেলে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি যাবেন না। 

১৭ নভেম্বর ২০১৮ সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হয়ে আমি  আর আমার বন্ধু আরটিভির স্টাফ রির্পোটার সুকান্ত সেন, খোকন ভাইয়ের অফিসে গেলাম। বললাম,  এখন জেলার  দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিজ এলাকায় চলে যান আবার।  অনেকতো কষ্ট করলেন। তিনি বললেন, ঠিক কইছিস তাই করতে হবে। আর পারিনারে। সেদিনকার মত বিদায় নিলাম।

পরে খবর এলো, খোকন ভাই মটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে উল্লাপাড়া পূর্বদেলুয়া ব্রীজের কাছে একজন মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই দূর্ঘটনায় পড়েছেন। মাথায় মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল ভীষণ। কষ্ট পেলাম এইতো কিছুক্ষন আগে যে মানুষটি সাথে কথা হলো।  এর পর এনায়েতপুরে নিয়ে যাওয়া হলো খোকন ভাইকে। পরে অবস্থার আরো অবনতি হলে রাতেই ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তখনো ভাবিনি আর দেখা হবে না। 

ঢাকায় খোকন ভাইয়ের চিকিৎসা চলছিল।  হঠাৎ ৯ জানুয়ারী খবর পেলাম, আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন প্রিয় খোকন ভাই। সাংবাদিকদের মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া।

আমরা হারালাম একজন বলিষ্ট নির্ভিক সাংবাদিককে। যিনি লোভ লালসাকে উপেক্ষা করে হয়ে উঠেছিলেন একজন অদর্শ সাংবাদিক। যার কলমে উঠে এসেছে এই জনপদের অনেক সম্ভাবনা, সফলতা, উন্নয়ন, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে অজস্র সংবাদ। লোভ লালসায় ভেসে যা্ওয়ার এ যুগে যে মানুষটিকে দরকার ছিল আরো অনেকটাদিন। খোকন ভাইয়ের নিজের কাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা আর মানুষের সাথে ব্যবহার দুটোই দারুণ শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। 

তার মতো একজন ভাল রিপোর্টারের শূন্যতা পূরন হবার নয়। আর কখনো ডাকবে না, হীরক আজ কোনো রিপোর্ট আছে নাকি রে। খোকন ভাই তার কর্মের  মধ্যে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

লেখক : চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি। 




 আরও খবর