শাহ আলমগীর আমাদের সময়ের নিঃসন্দেহে একজন আলোকিত সাংবাদিক। তার শেষ কর্মস্থল ছিল প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)। এই প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। তার চিরবিদায় আমাদের জন্য বহুমাত্রিক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। পেশাদার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তার কথা নানাভাবে বিশ্নেষণ করা যায়।
আমার কাছে তিনি ছিলেন অন্যরকম একজন মানুষ। বন্ধু, স্বজন, দায়িত্ববান সহযোদ্ধা হিসেবে তিনি নানাভাবে আলোচনায় উঠে আসেন। আমাদের প্রজন্মের যারা সৃজনশীল হিসেবে খ্যাতির সীমানায় বিস্তৃত, তাদের মধ্যে শাহ আলমগীর অনন্য। ২৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে তিনি ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি যখন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন, তখন সাংবাদিকদের অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকা তার কর্মময় জীবনের একটি প্রশংসনীয় অধ্যায়।
নির্ভরশীল সহযোদ্ধা, সহকর্মী, নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক শাহ আলমগীর আজ নেই; কিন্তু আমার মানসপটে ভেসে উঠছে তাকে ঘিরে কত কিছু! তিনি সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত হন ছাত্রজীবন থেকেই। উপমহাদেশের প্রথম শিশু-কিশোর সাপ্তাহিক 'কিশোর বাংলা' পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিকতায় তার হাতেখড়ি। তারপর তিনি দৈনিক জনতা, বাংলার বাণী, আজাদ, সংবাদ ও প্রথম আলোতে কাজ করেন। ক্রমেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে তিনি দ্যুতি ছড়াতে থাকেন। তিনি যখন আজাদে কাজ করতেন, তখন আমি সংবাদে। এক পর্যায়ে সংবাদ যখন ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন আমি তাকে নিয়ে আসি সংবাদে। সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেন এখানে।
আমাদের আরেক বন্ধু (তিনি এখন প্রবাসে) সাইফুল আমিনকেও নিয়ে আসি। যখন প্রথম আলো প্রকাশিত হতে যাচ্ছিল, তখন কথা ছিল দু'জনই যাব সেখানে। কিন্তু আমার যাওয়া হলো না; থেকে গেলাম সংবাদে। শাহ আলমগীর গুরুদায়িত্ব নিয়ে যোগ দিলেন প্রথম আলোতে। আমি পরবর্তীকালে দৈনিক যুগান্তরে গেলাম। সেখান থেকে চলে এলাম ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। একুশে টেলিভিশনে যোগ দিলাম। প্রথম আলো থেকে শাহ আলমগীরও চলে এলেন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। চ্যানেল আই তখন একজন যোগ্য-দক্ষ বার্তা সম্পাদক খুঁজছিল। শাহ আলমগীর সেখানে যুক্ত হলেন প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে। চ্যানেল আইকে নতুনরূপে উদ্ভাসিত করলেন শাহ আলমগীর।
এরপর যোগ দিলেন একুশে টেলিভিশনে বার্তা বিভাগের শীর্ষজন হিসেবে। সেখানেও আমার ভূমিকা ছিল। বলা যায়, হৃদয় ও পেশাদারিত্বের এ এক অটুট মেলবন্ধন। যমুনা ও মাছরাঙ্গা টেলিভিশনেও বার্তা বিভাগে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পিআইবিতে যোগদানের আগে এশিয়ান টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু যে সাংবাদিকতা পেশায়ই তিনি গণ্ডিবদ্ধ ছিলেন, তা নয়। তিনি শিশুকল্যাণ পরিষদ এবং শিশু-কিশোরদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান 'চাঁদের হাট'-এর সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।
তিনি পিআইবির মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করে মননশীলতা-সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন। পিআইবির নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে তিনি অনেকের সঙ্গেই কথা বলতেন। এ ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল আরও নিবিড়। এ জন্য আমি গর্ববোধ করি। পরামর্শ চাইতেন, নিতেন। তিনি অনেকের মতো উচ্চকণ্ঠ ছিলেন না। নিম্নকণ্ঠী এই মানুষটি তার অসাধারণ সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে যেসব কাজ করে গেছেন, সেগুলো দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে।
পেশাদারিত্বের ব্যাপারে আপসহীন শাহ আলমগীর আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছিলেন অন্যতম নির্ভরশীল ব্যক্তি। তিনি যে সাংবাদিকদের অধিকারের ব্যাপারে কতটা সোচ্চার ছিলেন, এর প্রমাণ পাই আমরা সাংবাদিকদের চাকরিবিধি প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে। তিনি তার কর্মজগতের গুরু ও দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকেও এ ব্যাপারে যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা আমরা কখনোই বিস্মৃত হতে পারব না। দুস্থ সাংবাদিকদের কল্যাণে গঠিত ট্রাস্টের ক্ষেত্রেও তিনি প্রভূত অবদান রেখেছেন। কাজ করেছেন সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা, একাগ্রতার প্রতি পূর্ণ অনুগত থেকে।
একাধারে পেশাদার, নিষ্ঠাবান, সৃজনশীল সাংবাদিক, দক্ষ প্রশিক্ষক হিসেবে পরিচিত-বিবেচিত এই মানুষটি সর্বক্ষেত্রেই তার অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন এবং সেই অধ্যায়গুলো এ মুহূর্তে আমার সামনে ভেসে উঠছে। তার কোনটা রেখে কোনটা বলি! আমি সত্যিকার অর্থে আমার একজন পরম বন্ধু, স্বজনকে হারালাম। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া এই উভয়ক্ষেত্রেই আমরা কাজ করেছি খুব ঘনিষ্ঠভাবে এবং এই কাজের অধ্যায়ের বাইরেও তাকে যেভাবে দেখেছি, নির্ণয় করার সুযোগ পেয়েছি, তার জন্যই তিনি আমার কাছে একজন অন্যরকম বড় মাপের মানুষ হিসেবে বিবেচিত।
শাহ আলমগীর অনেক কিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিলেন তার প্রতিভা, দক্ষতা ও যোগ্যতার কারণে। সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। শাহ আলমগীরকে পেশাগত জীবনে বিভিন্নভাবে দেখেছি, জেনেছি ও চিনেছি। তার মতো নিবেদিতপ্রাণ বন্ধু, স্বজন, সহযোদ্ধা খুঁজে পাওয়া ভার। তিনি অভিজ্ঞতায় কতটা ঋদ্ধ ছিলেন- এর প্রমাণ দিয়েছেন কাজের মধ্য দিয়ে। তার স্মৃতির প্রতি স্মরণাঞ্জলি কতভাবেই না অর্পণ করা যায়! সৃজনশীল মানুষ লোকান্তরিত হলেও কখনোই মানুষের হৃদয় থেকে বিস্মৃত হন না।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন
(লেখাটি ১ মার্চ দৈনিক সমকালের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত। - মুক্তবাক)