www.muktobak.com

আগস্ট ট্র্যাজেডি এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম


 আমীন আল রশীদ    ১২ মার্চ ২০১৯, মঙ্গলবার, ২:০২    বইপত্র


(গণমাধ্যমের উপস্থাপনা, উপস্থাপনার ভাষা, খন্ডিত তথ্য পরিবেশন অথবা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় পক্ষপাতের কারণে সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনমনে নানাসময়ে দেখা দেয় আলোচনা সমালোচনা। পেশাদারিত্বের অভাব আর স্বার্থ কখনও কখনও একাকার হয়ে যায়; দেখা দেয় নানা বিভ্রান্তি। গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব আর সংবাদ পরিবেশনের নানা অসঙ্গতি নিয়ে সাংবাদিক ও লেখক আমীন আল রশীদের পাঠক নন্দিত বই "বাংলাদেশের গণমাধ্যশ : জনআস্থার দোলাচল"। বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হবে মুক্তবাকে। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।)

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন, ওইদিন দৈনিক বাংলার প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘বঙ্গবন্ধু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন।’ এ উপলক্ষ্যে ওইদিন বিশেষ ক্রোড়পত্রও প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর পরদিনই পত্রিকার চেহারা এবং ভাষা আমূল পাল্টে যায়। ১৬ আগস্ট এই পত্রিকাটির কোথাও আর ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায় না। যে কয়বার তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছেÑলেখা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি তাঁকে যে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, সে কথাও কোনো সংবাদে উল্লেখ নেই।


পঁচাত্তর সালের আগস্টে দেশে চারটি সংবাদপত্র ছিল। দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজার্ভার ও বাংলাদেশ টাইমস। সবগুলোই ছিল রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত। ওই বছরের ১৬ জুন এই চারটি সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দৈনিক সংবাদসহ দেশের অন্য সবগুলো সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়। তবে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্র ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এই পত্রিকাগুলোর ভাষাও কিভাবে আমূল পাল্টে গেল, তা ১৬ আগস্টের পত্রিকাগুলোর দিকে নজর দিলে স্পষ্ট হয়।


এদিন দৈনিক বাংলার প্রধান শিরোনাম ছিল‘খোন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি।’ সাব হেড ছিল ‘শেখ মুজিব নিহত : সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি : সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ।’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার বাম পাশে কালো চশমা আর সাদা টুপি পরা খোন্দকার মুশতাককে সুপ্রিম কোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি এবি মাহমুদের শপথ পড়ানোর ছবি।
মূল শিরোনামে কোনো ডেটলাইন অর্থাৎ প্রতিবেদকের নাম বা পদবি ছিল না। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসের বরাত দিয়ে খবরের শুরুটা এরকম ‘শুক্রবার সকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। সশস্ত্র বাহিনীর এই ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে নিহত হন বলে ঘোষণা করা হয়।’


খবরে বলা হয় ‘সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক আইন ঘোষণা ও সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। দুপুরের পর অবশ্য মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে দেড় ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন তুলে নেয়া হয়।’ খবরে আরও বলা হয় ‘মুশতাক আহমদ পরে মুহাম্মদ উল্লাহকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করেন এবং ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠন ও ৬জন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করেন।’ আর তিন বাহিনীর প্রধানরা এই নয়া সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে বলেও খবরে বলা হয়।


প্রথম পৃষ্ঠায় আরও কয়েকটি খবর ছিল। এর মধ্যে একটির শিরোনাম ছিল ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপোস নেই।’ নয়া রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে বেতারে যে ভাষণ দিয়েছেন, তার বক্তব্যই ছিল এই খবরের বিষয়। এতে রাষ্ট্রপতির ঊধ্বৃতি দিয়ে বলা হয়েছে-‘একটি বিশেষ শাসকচক্র গড়ে তোলার লোলুপ আকাক্সক্ষায় প্রচলিত মূল্যবোধের বিকাশ ও মানুষের অভাব অভিযোগ প্রকাশের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। ....এ অবস্থায় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন সর্বমহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে।’
ওইদিন পত্রিকার সম্পাদকীয়ও ছিল প্রথম পৃষ্ঠায়। এতে বলা হয় ‘জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তির সূচনা হয়েছে। প্রাজ্ঞ জননায়ক খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী।’


এদিন শেষের পাতার বাম দিকে দুটি ছবি ছিল। এর একটিতে খোন্দকার মুশতাক শপথ গ্রহণের মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আর অন্য ছবিতে বঙ্গভবনের সামনে ট্যাংক প্রহরা। ডান দিকে ছিল বঙ্গভবনের মসজিদে খোন্দকার মুশতাকের জুমার নামাজ পড়ার ছবি। কিন্তু কোথাও বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের কারোর মৃতদেহের ছবি নেই। এমনকি পুরো পত্রিকা পড়ে বোঝার উপায় নেই যে, আগের দিন দেশের ইতিহাসে কী নৃশংস ঘটনা ঘটে গেছে!


কেবল দৈনিক বাংলাই নয়, পঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট বাকি তিনটি সংবাদপত্রের চেহারাও ছিল একমইরকম। ভাষাও অভিন্ন। এদিন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান খবরের শিরোনাম ‘দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ : সুবিচার ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা।’ এটি ছিল সাব হেড। আর মূল শিরোনাম ‘খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণ।’ ডেটলাইন ইত্তেফাক রিপোর্ট। খবরের শুরুটা এরকম ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন। শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স¡ীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।’


দেখা যাচ্ছে খবরের শিরোনাম এবং খবরের মধ্যে রাষ্ট্রপতি মোশতাকের নাম দুইরকম ছাপা হয়েছে। শিরোনামে লেখা হলো মোশতাক আর খবরের ভেতরে মুশতাক। আবার দৈনিক বাংলা লিখেছে মুশতাক। দৈনিক বাংলার মতো ইত্তেফাকেও কোথাও বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হবার বিস্তারিত বা আলাদা কোনো খবর নেই। খবরে লেখা হয়েছে, শেখ মুজিব স্বীয় বাসভবনে নিহত হয়েছেন। কিন্তু কে বা কারা হত্যা করেছে, তার উল্লেখ নেই।


১৬ আগস্ট ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার বাম দিকে একদম উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে বক্সসহ বিশেষ সম্পাদকীয়। শিরোনাম-‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা।’ এই সম্পাদকীয়তেও যথারীতি সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা আর জনগণের দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভের কারণেই যে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্রপতি শপথ নিয়েছেন, তা বলা হয়েছে। এদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় আরও যেসব শিরোনাম ছিল তার মধ্যে রয়েছে-‘জনসাধারণের স¡স্তির নিঃশ¡াস’; ‘উপরাষ্ট্রপতি, ১০জন মন্ত্রী ও ৬জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’; ‘যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালাইয়া যাইবে’ ইত্যাদি।


এর পরদিন ১৭ আগস্টের পত্রিকায়ও বঙ্গবন্ধু হত্যা বা এ বিষয়ক কোনো খবর ছিল না। বরং মুশতাক আহমদের জীবনী প্রথম পৃষ্ঠায় বেশ বড় করে ছাপা হয়। এদিনের মূল শিরোনাম ছিল-‘রাষ্ট্রপতি মোশতাকের প্রতি বাদশাহ খালেদ ও প্রেসিডেন্ট নিমেরির অভিনন্দন : সৌদি আরব ও সুদানের স্বীকৃতি।’
১৯৭৫ সালে এই দুটি বাংলা পত্রিকার বাইরে আরও দুটি ইংরেজি পত্রিকা ছিল। বাংলাদেশ অবজারভার ও বাংলাদেশ টাইমস। ১৬ আগস্ট অবজারভারের প্রধান শিরোনাম ছিল-Mushtaque Becomes President: Mujib Killed : Situation Remain Calm.  আর সাব হেড ছিল- Armed Forcec Take Over: Martial Law Proclaimed : Curfew Imposed. এই খবরের বক্তব্যও দৈনিক বাংলা ও ইত্তেফাকের মতো। বলা যায় বাংলা পত্রিকার ইংরেজি ভার্সন।

এদিন পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখা হয় প্রথম পৃষ্ঠায়। যার শিরোনাম ছিল: Historical Necessity. বাংলা পত্রিকার মতো এই সম্পাদকীয়তেও মন্তব্য করা হয়েছে ইতিহাস আর সময়ের প্রয়োজনেই সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। যথারীতি বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের ব্যাপক সমালোচনাও করা হয় এখানে। তবে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি বক্স আইটেম ছিল, যার শিরোনাম: Pakistan Accords Recognition. এই ঘটনার পরে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্তের খবরটি বক্স আইটেম করার পেছনে যে সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য ছিল, তা বলাই বাহুল্য। তার মানে দাঁড়ায়, এতদিন বঙ্গবন্ধু জীবিত ছিলেন বলেই বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়নি। তিনি নিহত হবার পরেই পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আর তৎকালীন সংবাদপত্রগুলোও এই খবর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপতে বধ্য হয়। খবরের ভাষায় মনে হতে পারে, যেন পাকিস্তানের স্বীকৃতির জন্য এতদিন অধীর আগ্রহে ছিল বাংলার মানুষ। খবরের এই ভাষাই বলে দেয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা বসেছেন, তাদের পেছনের শক্তি আসলে কারা।

একইভাবে আমরা দেখতে পাই, এই ঘটনার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজ চালিয়ে যাবে, সেই খবরও পত্রিকায় গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়েছে। কিন্তু এই নৃশংস ঘটনার পরে প্রতিবেশী দেশ, যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দারুণ সহায়তা করেছিল, সেই ভারতের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?


১৭ আগস্ট 'Indian Reaction 'শিরোনামে বাংলাদেশ অবজারভার লিখছে, 'Vhese are Internal matters of Bangladesh'.  দিল্লির একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এই খবরে বলা হয়েছে, ভারত সরকার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির ওপর সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং নজর রাখছে এর পরবর্তী ঘটনার দিকে। ওই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে খবরে আরও বলা হয়, ভারতের জনগণ উপমহাদেশের সব দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চায়।
এদিনের অবজারভারে আরেকটি খবর ছিল 'Bhashani extends full support'. এই খবরে বলা হয়, ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পরে যে সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, তাদের প্রতি মওলানা ভাসানী পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।


আরেকটি খবরের শিরোনাম 'Bangalis Smash Mujib's Pictures in London'. এই খবরে বলা হয়, প্রায় ২০০ লন্ডন প্রবাসী বাঙালি গতকাল বাংলাদেশের নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে মিছিল করেছে এবং নিহত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ভাংচুর করে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এবার নজর দেয়া যাক অপর ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমসের দিকে। ১৬ আগস্ট এই পত্রিকার মূল খবরের শিরোনাম- 'Martial Law Proclaimed in the Country: Mujib Killed: Mushtaque Assumes Presidency'. প্রথম পৃষ্ঠার বাম পাশে সম্পাদকীয়। শিরোনাম: 'Our Comment: On The Threshold of A New Era' বলাই বাহুল্য, এই পত্রিকার শিরোনাম এবং খবর বাংলাদেশ অবজারভারের চেয়ে খুব একটা আলাদা ছিল না।


মোদ্দা কথা, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এ চারটি পত্রিকার শিরোনাম ও খবরের বিষয়বস্তু ছিল অভিন্ন। কেবল ভাষার পার্থক্য ছিল। তাও খুব বেশি নয়। বরং সংবাদগুলো পড়লে পাঠকের মনে হবে, সবগুলো খবর বুঝি একজনই লিখেছেন। পরে পত্রিকাগুলো তাদের নিজেদের মতো করে কিছুটা সম্পাদনা করেছে এবং সাজিয়েছে। গবেষণার বিষয়, ওই সংবাদেও মূল কপিটা কে লিখেছিলেন? কোনো সামরিক ব্যক্তি নাকি কোনো সাংবাদিক? কোনো সাংবাদিক লিখলে যে তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে এই ভাষা লেখানো হয়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।


প্রবীণ সাংবাদিক কামাল লোহানী একটি সাক্ষাৎকারে (অগ্রজের সঙ্গে একদিন, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, পৃষ্ঠা ৪৬) আগস্ট ট্র্যাজেডির পরদিন গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আিিম সম্ভবত তখন দৈনিক বাংলার বাণীতে কাজ করি। সঠিক মনে নেই। খবরের কাগজগুলো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং এই ঘটনাবলি প্রকাশ করার মতো কোনো অবস্থা ছিল না। না ছবি, না কথা, না কিছু এবং সরকারের ওপর থেকে একটা নিষেধাজ্ঞা আসলো। মৌখিক। লিখিত কোনো নির্দেশ ছিল না যতদূর মনে পড়ে। এগুলোর বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট ছাপানোর সাহস করেনি কেউ ঘটনার আকস্মিকতায়।’
যে মানুষটির ডাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একাত্তরে, চার বছর যেতে না যেতেই সেই মানুষটির সপরিবারের করুণ মৃত্যুর খবর ওই সময়ে দেশের কোনো পত্রিকা ছাপলো না, এটা কী করে সম্ভব হলো? সম্ভব হয়েছিল এ কারণে যে, তখন সংবাদপত্রের কোনো স¡াধীনতা ছিল না। নিহত হবার আগেই বঙ্গবন্ধু চারটি বাদে সবগুলো দৈনিক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। আর সেই ধারাবাহিকতায় সামরিক সরকারও পত্রিকাগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণেই রাখে। তারা যেভাবে নির্দেশ দেয়, সেভাবেই খবর প্রকাশিত হয়।


একটা বিষয় এখানে উল্লেখ্য, ওই সময় দৈনিক পত্রিকার সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল কম। এখন টেলিকমিউনিকেশন, মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি থেকে শুরু করে দেশীয় খাদ্য ও পানীয়সহ হাজারো শিল্প-প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য প্রসার এবং ল্যান্ড ডেভেলপাররা ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য নির্ভর করেন দৈনিক পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ওপর। কিন্তু পঁচাত্তর সালে সদ্য স¡াধীন দেশে এরকম শিল্প বিকশিত না হওয়ায় পত্রিকাগুলোকে অনেকটা সরকারের দয়ায় চলতে হত।
দ্বিতীয়ত, তখন মিডিয়ায় এখনকার মতো এত কর্মী ছিল না। তাছাড়া তখন গণমাধ্যমের স¡াধীনতা রক্ষার বিষয়টিও খুব বেশি আলোচিত ছিল না। এক্ষেত্রে বিশ¡ নজরদারিও প্রায় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন স্যাটেলাইট আর ইন্টারনেটের অভাবনীয় বিস্তৃতির ফলে এবং বিশ¡জুড়ে সিপিজে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ এরকম অসংখ্য সংস্থার তৎপরতার ফলে সাংবাদিক নির্যাতন ও পত্রিকার স্বাধীনতাহরণ তাৎক্ষণিকভাবে জানাজানি হয়ে যায়। বিশ¡ জনমত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। কিন্তুপঁচাত্তরের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ফলে দেখা যায় ওই সময়ে যে চারটি পত্রিকা বের হতো, তার সবগুলোর প্রিন্টার্স লাইনই ছিল এরকম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অমুক প্রিন্টিং প্রেস থেকে সম্পাদক কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। আবার ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমসে সম্পাদক হিসেবে যথাক্রমে নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী ও আবদুল গণি হাজারীর নাম থাকলেও বাংলাদেশ অবজারভারের প্রিন্টার্স লাইনে কোনো সম্পাদকের নাম ছিল না।


গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নিন্ত্রণ থাকলে সত্য ঘটনা কিভাবে আড়াল হয়ে যায়, তার একটি বড় উদাহরণ আগস্ট ট্র্যাজেডি। এর কাছাকাছি ঘটনা ঘটেছিল ওয়ান ইলেভেনের পরে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দেশের রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তারের পরেও এরকম বেশ কিছু খবর আমাদের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। সে সময় দেখা গেছে, রিমান্ডে অনেক প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ নিজেদের ‘অপকর্মের’ কথা স¡ীকার করেছেন বলে পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই খবরগুলো কোনো পত্রিকায় রিপোর্টার নিজে অনুসন্ধান করে বের করেছেন, এমন নয়। বরং এই খবরগুলো একটি বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী গণমাধ্যমে সরবরাহ করে এবং খবরগুলো প্রকাশের ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করে। তারপরও একটি দুটি পত্রিকা এই চাপ উপেক্ষা করে এসব খবর ছাপেনি। কিন্তু পঁচাত্তর সালে কোনো পত্রিকার পক্ষে এরকম সাহসী হওয়ার সুযোগ ছিল না। কারণ তখন পত্রিকাগুলোর আর্থিক সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। সবগুলোই ছিল সরকারের মুখপত্র। সংবাদপত্র বলতে যা বোঝায়, তা নয়। আর এ কারণেই আমরা দেখতে পাই মুক্তিযুদ্ধ এবং তার আগে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনে দৈনিক ইত্তেফাকের যে সাহসী ভূমিকা ছিল, তার সঙ্গে পঁচাত্তর ট্র্যাজেডির সময়কালের চরিত্র কোনোভাবেই একদমই মেলে না।




 আরও খবর