www.muktobak.com

সংবাদ সম্মেলন নিজেই যখন সংবাদ


 আমীন আল রশীদ    ১৯ মার্চ ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:০৮    বইপত্র


(গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব আর সংবাদ পরিবেশনের নানা অসঙ্গতি নিয়ে সাংবাদিক ও লেখক আমীন আল রশীদের পাঠক নন্দিত বই "বাংলাদেশের গণমাধ্যশ : জনআস্থার দোলাচল"  প্রকাশ হয় এবছর অমর একুশে বইমেলায়।। বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে মুক্তবাকে। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।)

কোনো বিশেষ সংবাদ জানানোর জন্য সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও সংবাদ সম্মেলন নিজেই কখনও সংবাদ হয়ে ওঠে; যার একটি বড় উদাহরণ ব্রিটিশ আইনজীবী আলেক্সান্ডার কার্লাইলের সংবাদ সম্মেলন। যুক্তরাজ্যের লর্ড সভার সদস্য বলে সংক্ষেপে যিনি লর্ড কার্লাইল নামেই বেশি পরিচিত। স্মরণ করা যেতে পারে, তিনি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
দুর্নীতি মামলায় কারান্তরীণ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনি লড়াইয়ের ইস্যুতে এই আইনজীবী ভারতের ভিসা নিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালের ১১ জুলাই রাতে দিল্লি বিমানবন্দর থেকেই তাকে ফেরত পাঠানো হয়। অভিযোগ, তিনি ভিসার শর্ত মানেননি। আরও পরিস্কার করে বললে, তিনি নিয়েছিলেন বিজনেস ভিসা। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সংবাদ সম্মেলন। তাও যেনতেন বিষয় নয়, খালেদা জিয়ার কারাবাস, জামিন ইত্যাদি ইস্যুতে। যেখানে ঢাকা থেকে যাওয়া বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা এবং খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের সঙ্গেও তার দেখা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিমানবন্দর থেকেই তাকে ফেরত পাঠানো হয় এবং লন্ডনে ফিরে গিয়ে তিনি টেলিফোনে সংবাদ সম্মেলন করেন দিল্লির সাংবাদিকদের সাথে।

পড়ুন প্রথম পর্ব : আগস্ট ট্র্যাজেডি এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম


কার্লাইলের ভারতে এসে সংবাদ সম্মেলন করার এই পুরো প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করেছিল দিল্লিতে ফরেন করেসপনডেন্ট ক্লাব। ফলে তিনি লন্ডনে ফিরে গিয়ে তাদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের আয়োজন করেন। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভিডিও কনফারেন্সটিও হয়নি। ফলে তিনি দিল্লির সাংবাদিকদের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। আবার ওই কনফারেন্সে দিল্লির কয়েকজন এবং শুধুমাত্র একজন জাপানি সাংবাদিক ছাড়া অন্য কোনো দেশের সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন না বলে আমাকে জানান দিল্লি প্রেসক্লাবের সভাপতি গৌতম লাহিড়ী। তার মানে কি মি. কার্লাইলের এই সংবাদ সম্মেলনটিকে তারা খুব একটা পাত্তা দেননি?
এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। সেখানে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, ভিসায় ভারতে প্রবেশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কার্লাইল যা উল্লেখ করেছেন, তার সঙ্গে ভারতে আসার উদ্দেশ্যের মিল ছিল না বলে বিমানবন্দরে অবতরণ করলেও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে লন্ডনের ফিরতি ফ্লাইটে তুলে দেয়।
লন্ডন থেকে টেলিফোনে কার্লাইল সাংবাদিকদের বলেন, দুর্নীতি মামলায় সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আদালত খালেদা জিয়াকে যে সাজা দিয়েছেন, সে বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য নেই। বরং তার মূল উদ্দেশ্য ছিল খালেদা জিয়ার ইস্যুটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ। তিনি বলেন, ভারতের মতো একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশ তার সঙ্গে যে আচরণ করলো, তাতে ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি তার শ্রদ্ধা শেষ হয়ে গেছে। এমনকি তিনি এও বলেছেন যে, রাজনৈতিক চাপের মুখে ভারত নতি স্বীকার করেছে।
যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দাবি, কার্লাইলকে ফেরত পাঠানো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে বাংলাদেশ সরকার বা আওয়ামী লীগের কোনো হাত নেই। তবে এটা ঠিক যে, কার্লাইল যাতে ভারতে গিয়ে খালেদা জিয়ার ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন করতে না পারেন, সে বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে এবং শেষমেষ কার্লাইল যে আরেকটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তৃতীয় একটি দেশে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনটি করতে পারলেন না, সেটিকে দুদেশের সফল কূটনৈতিক তৎপরতা হিসেবেই দেখা যায়।
প্রশ্ন হলো, মি. কার্লাইল সংবাদ সম্মেলনের জন্য দিল্লি¬কেই বেছে নিলেন কেন? তার ভাষ্য অনুযায়ী, খালেদা জিয়ার ইস্যুটি যদি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণই তার মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে এই সংবাদ সম্মেলনটি তিনি যুক্তরাজ্যেই করতে পারতেন। তাতে এর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাভারেজ বরং আরও বেশি পেতো। তাহলে কি তিনি চেয়ছিলেন, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে একটা তিক্ততার সৃষ্টি হোক?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, কার্লাইল দিল্লিতে এসে সংবাদ সম্মেলনের সিদ্ধান্তটি কি নিজে নিয়েছিলেন না কি লন্ডনে বিএনপির যে নেতৃত্ব, অর্থাৎ যারা তাকে নিয়োগ করেছেন তাদের পরামর্শে? কারণ লর্ড কার্লাইলের মতো একজন বিচক্ষণ আইনজীবী এবং যিনি একইসঙ্গে যুক্তরাজ্য লর্ড সভারও সদস্য, তিনি কি এটি জানতেন না যে, খালেদা জিয়ার ইস্যুতে ভারত সরকার কোনোভাবেই তাকে সংবাদ সম্মেলন করতে দেবে না?
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রও দাবি করেছেন যে, এই ইস্যুতে কার্লাইল শুধু বাংলাদেশ-ভারত নয় বরং ভারতের সাথে বিএনপিরও দূরত্ব তৈরি করতে চেয়েছেন। যদিও এই যুক্তিটি খুব গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ কার্লাইল যেহেতু বিএনপির পার্পাস সার্ভ করতে চান, সুতরাং ভারতের সাথে এই দলটির দূরত্ব তৈরি হোক, সেটি তার চাওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে এই সংবাদ সম্মেলনের আগে যেখানে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ভারতে গিয়েছিলো সে দেশের থিংকট্যাংকের আমন্ত্রণে। সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের সাথে তাদের কোনো বৈঠক না হলেও জাতীয় নির্বাচনের বছরে ভারতের ক্ষমতাসীনদের সাথে ঘনিষ্ঠ কোনো থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনারও রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি নিজেও হয়তো চায় ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নয়ন হোক।
পাল্টা প্রশ্নও করা যায় যে, মি. কার্লাইল আসলেই বিএনপির পার্পাস সার্ভ করছেন কি না এবং তিনি যে খালেদা জিয়ার ইস্যুতে দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন করতে চাইলেন, সেখানে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কি অনুমোদন ছিল? আবার বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বলতে আমরা এ মুহূর্তে কাকে বুঝি? বেগম জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করছেন তার বড় ছেলে তারেক রহমান, যিনি লন্ডনে থাকেন এবং গ্রেপ্তারের ভয়ে দেশে আসছেন না। হাজার মাইল দূরে বসে দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি দল পরিচালনা কি এতই সহজ? আর বিএনপি নিশ্চয়ই কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি নয় যে তাকে গোপন বাঙ্কারে বসে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিতে হবে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো সজ্জন এবং পণ্ডিত নেতা যে দলে আছেন, সেখানে দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণ হয় অন্য আরেকটি দেশ থেকে এর দ্বারা বস্তুত বিএনপির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পায়। দ্বিতীয়ত, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যে এখনও পরিবারতন্ত্রের ঘেরাটোপ বেরিয়ে আসতে পারেনি এবং সেটি যে দলের চূড়ান্ত সংকটকালেও না; বিএনপি তার বড় উদাহরণ।
কার্লাইলের সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র নেতাদের অনুমোদন ছিল কি না এ প্রশ্নটি তুলবার আরেকটি কারণ হলো, যখন তিনি খালেদা জিয়াকে আইনি পরামর্শ দেয়ার জন্য বাংলাদেশে আসবেন বলে শোনা গিয়েছিল, তখনই এটি নিয়ে দলের ভেতরে মতপার্থক্য  তৈরি হয়েছিল। আবার এই ইস্যুতে লন্ডন থেকে কার্লাইলকে উড়ে আসতে হলে তখন এ প্রশ্নও উঠতো যে, খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কিংবা খন্দকার মাহবুবের মতো জাঁদরেল উকিল-ব্যারিস্টাররা কি যথেষ্ট নন? কথা হচ্ছে, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আইনজীবী হিসেবে তৃতীয় আরেকটি দেশে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন কোনো শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। তাহলে প্রশ্ন, কার্লাইলকে এরকম একটি সংবাদ সম্মেলন করতে কে বা কারা উদ্বুদ্ধ করলো-যে সংবাদ সম্মেলনটি ভারতের মাটিতে হবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না?

 




 আরও খবর