সংবাদ সম্মেলনের সংবাদ হওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমাদের দেশে প্রায়ই তৈরি হয় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন ঘিরে। সাধারণত বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে সফরের আদ্যোপান্ত তুলে ধরতে গণভবনে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় যেখানে গণমাধ্যমের সম্পাদক পর্যায়ের সিনিয়র সাংবদিকরা উপস্থিত থাকেন। অনেক সময় এর নিচের পদের সাংবাদিকরাও থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলনে দুয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশই যেসব প্রশ্ন করেন, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে সমালোচনা হয়। সিনিয়র সাংবাদিকদের ‘তেলবাজির’ তীর্যক মন্তব্য করেন জুনিয়ররাও। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে তার সফর কিংবা সাম্প্রতিক বিষয় ছাপিয়ে অনেক সময় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এই প্রশ্ন এবং প্রশ্নের ধরন।
২০১৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের দিন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়–য়া ফেসবুকে গণমাধ্যমের ইংরেজি Mass Media শব্দকে উপহাস করে লিখেছেন : মাছ মিডিয়া। তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে কিছু সাংবাদিকের তোষামেদির প্রেক্ষিতেই এটি লিখেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন ফেসবুকে লিখেছেন: সব সময় সবকিছুর একই নাম থাকতে হবে কেন, যখন অর্থ বদলে যায়? যেমন, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে ‘প্রশ্নোত্তর পর্ব’।
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন : সংবাদ সম্মেলন নিজেই যখন সংবাদ
২ সেপ্টেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে একজন টেলিভিশন সাংবাদিকের প্রশ্নের ধরন ও বাক্য নিয়ে পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক নঈম নিজামও ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে ২০১০ সালের পর থেকে এক নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এই সংস্কৃতি আগে ছিল না। ২০১৪ সালের পর এই সংস্কৃতির আরও ডালপালা বেড়েছে। অনুজদের কোনো দোষ নেই। এই সংস্কৃতি প্রবীণরা শিখিয়েছে নবীনদের।’ এ বিষয়ে তিনি একটি অনুরোধও করেন, ‘অনুজদের প্রতি অনুরোধ, আমাদের কিছু মানুষ অকারণে সংবাদ সম্মেলনে বেশি কথা বলেছেন, বলছেন। কিন্তু তা অনুকরণের দরকার নেই। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন কর সবাই। জানতে চাও। প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করতে হলে, লেখো, টকশোতে কথা বল। তা না পারলে মানুষের সামনে হেঁটে হেঁটে বল। ফেসবুকে লেখো। অনলাইনে লেখো। লাইভ সংবাদ সম্মেলনে অতি চাটুকারী করে প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত ও একটি পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার দরকার নেই। আর সিনিয়রদের বলছি, অনেক তো হলো প্লিজ নির্লজ্জের মতো নবীনদের এমন কিছু শেখাবেন না। যা বিব্রত করে সবাইকে।’
প্রশ্ন হলো কেন প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে সাংবাদিকদের কেউ কেউ নিজেদের পেশাদারিত্ব বিসর্জন দিয়ে এরকম তোষামোদি করেন? শুধু তাই নয়, কখনো কখনো সাংবাদিকের প্রশ্ন এবং প্রধানমন্ত্রীর উত্তর শুনে সেখানে হাততালি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা হাততালি দেন এরকম অদ্ভুত ঘটনা অন্য কোনো দেশে ঘটে কি না সন্দেহ।
প্রথম পর্ব পড়ুন: আগস্ট ট্র্যাজেডি এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও যে এই তোষামোদি খুব পছন্দ করেন, তা নয়। বরং তিনি একবার এক সিনিয়র সাংবাদিকের প্রশ্ন করার নামে লম্বা বক্তৃতা শুনে উল্টো ওই সাংবাদিককে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি প্রশ্ন করছেন নাকি বক্তৃতা দিচ্ছেন? তখন ওই সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘আমার কোনো প্রশ্ন নেই’।
তাহলে কেন তারা সংবাদ সম্মেলনে যান? এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে।
১. পেশাদারিত্বের সংকট: হাতেগোনা দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে এ মুহূর্তে দেশের কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেই যে পেশাদারিত্বের চর্চা হয় না, সে বিষয়ে বোধ করি কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। কোনোদিন সাংবাদিকতা করেননি এমন লোকও পত্রিকার সম্পাদক, টেলিভিশনের বার্তা প্রধানের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যাচ্ছেন। এতে সাংবাদিককার ডিগনিটি ক্ষুণ হয়। এবং এই লোকগুলো মূলত প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে যান নিজের চেহারাটা দেখানোর জন্য। তিনি কোনো প্রশ্ন করেন না বা প্রশ্ন করার ক্ষমতাও তার নেই। বরং তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে গেলেন বা যেতে পারলেন, সেটিই তার অস্ত্র।
২. বিশেষ সুবিধা আদায়: অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে (যেকোনো আমলেই) যারা যান, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই সুবিধাবাদ ও ধান্দাবাজ গোষ্ঠী যারা পেশাদার সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার পথও বন্ধ করে দেন বা কঠিন করে দেন। যখন কোনো সিনিয়র সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর তোষামোদি করতে থাকেন তখন অপেক্ষাকৃত তরুণরা সমসাময়িক ইস্যুতে কোনো কঠিন প্রশ্ন করতে সংকোচবোধ করেন। অবশ্য আজকাল তরুণদেরও অনেকে তোষামোদি করেন।
৩. সরকারের সুনজরে থাকা: আমাদের গণমাধ্যমে পেশাদারিত্বের সংকট, কালোটাকার দৌরাত্ম্য, অসৎ লোকের দাপট ইত্যাদি কারণে সরকারগুলো সব সময়ই সাংবাদিকদের একধরনের চাপের মধ্যে রাখে বা রাখতে পারে। কারণ অধিকাংশ গণমাধ্যম মালিকেরই প্রচুর অবৈধ আয়ের উৎস আছে এবং সেগুলো সরকারের জানা। সুতরাং কালো টাকার মালিকদের গণমাধ্যমের পক্ষে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ থেকে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করাও কঠিন। ফলে মালিকরা সব সময়ই সরকারের সুনজরে থাকতে চান। অর্থাৎ এই সুনজের থাকতে চাওয়ার মূল কারণ ভয়।
৪. দলীয় আনুগত্য: বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বহু বছর ধরেই আওয়ামী ও বিএনপিপন্থি এ দুই ভাগে বিভক্ত। জাতীয় প্রেসক্লাব, বিএফইউজে, ডিইউজের মতো সংগঠনের নির্বাচন হয় দলীয় ব্যানারে। কে কোন দলের অননুগত বা সমর্থিত প্রার্থী, তা নিয়ে কোনো লুকোছাপা থাকে না। শুধু নির্বাচন নয়, এসব সংগঠনের সদস্য নিয়োগও হয় দলীয় বিবেচনায়। ফলে সাংবাদিকতার নিরপেক্ষ এবং বস্তুনিষ্ঠ চরিত্র হারিয়ে গেছে। প্রতিবেশী ভারতে কংগ্রেসপন্থি বা বিজেপিপন্থি, যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটপন্থি বা রিপাবলিকপন্থি সাংবাদিক সংগঠন নেই এবং এটা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু বিএনপি-আওয়ামীপন্থি সংগঠনই নয়, সিনিয়র সাংবাদিকদের একটা বড় অংশকেই সাধারণ মানুষ দলীয় কর্মী মনে করে। সুতরাং দলীয় কর্মীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে কোনো সাহসী এবং প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা সম্ভব নয়।
আমরা যদি দেশের প্রধান দুটি দলের দুই নেত্রীর মধ্যে তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা তুলনামূলকভাবে বেশি সাংবাদিকবান্ধব। বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ে তো বটেই, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনও তাকে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা সহজ এবং তিনি সব প্রশ্নেরই সাবলীলভাবে জবাব দেন। যে প্রশ্ন তার অপছন্দের, সেই প্রশ্নেরও তিনি ব্যাখ্যাসহ জবাব দেন। অথচ সাংবাদিকরা এই সুযোগ পেয়েও তাকে অনেক সময় প্রয়োজনীয় প্রশ্নটি না করে তোষামোদি করেন। এর মাধ্যমে তারা কে কী অর্জন করেন বা করেছেন তা তারাই ভালো বলতে পারবেন।
পক্ষান্তরে খালেদা জিয়া তুলনামূলক বেশি ‘রিজার্ভ’ এবং সাধারণত তিনি সংবাদ সম্মেলনেও কোনো প্রশ্ন নেন না। বরং তিনি তার কথা বলে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে চলে যান। ফলে তার সংবাদ সম্মেলনটি অনেক সময়ই একক বক্তৃতায় পরিণত হয়। বেগম জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন দেখা গেছে তরুণদের কেউ কেউ সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন করার প্রস্তুতি নিলেও দলীয় আনুগত্যশীল সিনিয়র সাংবাদিকরা ওইসব তরুণকে প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করেন। সাহসী প্রশ্ন করার কারণে কোনো কোনো সাংবাদিক তার সহকর্মীদের হাতে নাজেহাল হয়েছেনÑএমন কথাও শোনা যায়।
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে নিয়মিত যানÑএরকম একজন সিনিয়র সাংবাদিককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে সম্পাদক পর্যায়ের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তারা উপস্থিত থাকেন, এটি যেমন ঠিক, তেমনি প্রধানমন্ত্রী যে বিষয় নিয়ে কথা বলবেন, ধরা যাক রোহিঙ্গা ইস্যুÑসেই বিটের সাংবাদিকদেরও সংবাদ সম্মেলনে থাকা উচিত এবং মূল প্রশ্নটি করা উচিত তাদের। জ্বালানি ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী যখন কথা বলবেন, তখন জ্বালানি বিষয়ে অভিজ্ঞতা না থাকলে তিনি কী করে এ বিষয়ে প্রশ্ন করবেন?
অনেকে মনে করেন, আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে যেসব ঘটনা ঘটে তাতে ভবিষ্যতে হয়তো সাংবাদিকতার অধ্যয়নে ‘প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন’ নামে একটি আলাদা অধ্যায় চালু করতে হবে।