'শুনেছি, প্রথম আলো তাদের বেশকিছু সাংবাদিক-কর্মীকে ছাঁটাই করতে যাচ্ছে! মুনাফা বা লাভ কমে গেলে অনেক প্রতিষ্ঠানই খড়গ চালায় প্রথমে কর্মীদের ওপর! এর চাইতে নির্মম আর কিছু নেই।
বাংলাদেশে প্রথম আলো দুটি দৈনিকের একটি যারা সাংবাদিকদের ঈর্ষা করার মতো সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা দিয়েছে! একই সঙ্গে সাংবাদিকতাকে করপোরেট সংস্কৃতির জায়গায় নিয়ে গেছে! এটা ভালো কি মন্দ, তা সময়ই বলবে।
আমার নিজের ধারণা, করপোরেট চরিত্রটা হচ্ছে অনেকটা এ রকম- তারা আপনাকে পছন্দ হলে নিচতলা থেকে বাহাত্তর তলায় তুলবে, তারপর পছন্দ না হলে ধাক্কা মেরে একদম নিচে ফেলে দেবে!
এ ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে প্রথম আলোর পাঠকসংখ্যা কমছে, এর সঙ্গে সঙ্গে এর মুনাফাও হয়তো কমেছে! মুনাফা কমে গেলে কর্মী ছাঁটাই করে তা সমন্বয় করার চেষ্টা যে সব প্রতিষ্ঠান করে তারা শেষ পর্যন্ত আসলে টিকে থাকতে পারে না! কারণ, এমন প্রতিষ্ঠান থেকে যারা ছাঁটাই হন তারা তো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে পড়েনই, যারা থেকে যান তাদের মধ্যেও ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়। সেটা কর্মীদের ওপর খুবই মনস্তাত্বিক প্রভাব ফেলে। তাদের তখন মনে হয়, এ প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের নয়। যে কোনো সময়ে আক্রান্ত হতে পারেন তারাও। এমন অনিশ্চয়তা বোধ থেকে কারোর পক্ষেই কেবল মেধা ঢেলে কাজ করা সম্ভব না।
তা ছাড়া, এ ধরনের ছাঁটাই প্রক্রিয়ায় সব সময় যে অদক্ষরা বাদ পড়েন তা না। বাদ পড়েন আসলে মেরুদণ্ডঅলারাই।
যে কোনো মিডিয়া হাউজেই অপেক্ষাকৃত অদক্ষ ও মেধাহীনরাই সম্পাদকের চারপাশে একটা বলয় সৃষ্টি করে রাখেন। সম্পাদকতোষণে তারা এতোটাই দক্ষ থাকেন যে তারাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন। বাদ পড়েন সবচাইতে নিষ্ঠাবান ও মেধাবীরাই।
কারণ, মেধাবীরা হয়তো মনে করেন মেধাই তাদের সম্বল। এটাই তাকে সব রকমের সুরক্ষা দেবে। কিন্তু তা সব সময় হয় না। সম্পাদককে নিয়মিত তোষণ না করলে সম্পাদক এক সময় মনে করেন, কখনো কখনো তাকে অন্যরাও মনে করিয়ে দেন যে অমুক তাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না!
প্রথম আলোর সম্পাদককে আমি যতোটা চিনি তাতে করে এই শঙ্কা আমার আছেই যে সেখান থেকে বাদ পড়তে পারেন অনেক প্রকৃত মেধাবীও। অথচ বহাল থাকতে পারেন অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ও সম্পাদকতোষণকারীরাই।
না। এই চরিত্র কেবল তিনিই ধারণ করেন এমন নয়। বাংলাদেশের বাকি সম্পাদকদের সম্পর্কেও আমার ধারণা অনেকটা এমনই। এক-দুজন ব্যতিক্রম থাকলেও থাকতে @@পারেন।
প্রথম আলোই শুধু নয়, আরো কিছু দৈনিক ও চ্যানেলেও নাকি এ রকম ছাঁটাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে! যে কোনো প্রতিষ্ঠানেই হোক না কেন, কর্মী ছাঁটাইয়ের কাজটাকে আমার খুবই নির্মম এবং নির্দয় কাজ মনে হয়। যারা চাকরি হারান বা কর্মক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হন তারা যে কী রকম আর্থিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েন সেটা আমার চাইতে বেশি কে আর বুঝবেন!
সম্পাদকের রোষানলে পড়ে ভোরের কাগজ থেকে আমি ইস্তফা দিয়ে কতোটা বিপদে পড়েছিলাম, সেটা মনে হলে আজও শিউরে উঠি। কোনো চাকরিবাকরির ব্যবস্থা না করেই আমি রিজাইন করি। মতিউর রহমানের জীবনে আমার যেটুকু সামান্য ভূমিকা ছিলো তাতে অবচেতন মন বলছিলো, তিনি হয়তো ততোটা নির্মম হবেন না আমার প্রতি। আমার ইস্তফাপত্র হয়তো তিনি ফিরিয়ে দিয়ে বলবেন, আগে একটা চাকরি খোঁজেন, তারপরে যান!
তিনি তা করেননি! আমার ইস্তফাপত্র তিনি সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে গ্রহণ করেছিলেন যে মনে হয়েছিলো, আমি চলে গেলেই তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন!
আমার সাংবাদিকতাজীবনের সেই যে সমাপ্তি ঘটলো, আর ফিরে যেতে পারিনি! আমাদের দেশের সাংবাদিকরাও এমনই মেরুদণ্ডহীন যে কারোর ওপর অবিচার হলে অন্যরা মুখই খুলতে চান না। আমার সময়ে কেউ মুখ খোলেননি! আজও কাউকে মুখ খুলতে দেখি না! এমনকি কেউ জোর চেষ্টা না করলে তার পক্ষে উপযুক্ত জায়গায় যাওয়াও কঠিন। তার দিকে কেউ ফিরেও তাকান না। যেমন কেউ তাকাননি আমার দিকেও। অন্তত নাঈমুল ইসলাম খান ছাড়া আমার কোনো সাংবাদিকবন্ধু আমাকে কখনো ডাকেনওনি!
দেশে গোটা পাঁচেক মেরুদণ্ডী সাংবাদিকও কি নেই, যারা এমন অবিচারের বিরুদ্ধে এবং ক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াতে পারেন? আমাদের সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলিও মনে হয়, অকর্মণ্যদের দখলেই।
আমার চারপাশে অনেকে ঠিকঠাক সাংবাদিক না হলেও নামের পাশে সাংবাদিক লেখেন! আমি তো কম দিন সাংবাদিকতা করিনি! দৈনিক জনপদে তিন বছর, আজকের কাগজে এক বছর, ভোরের কাগজে ছয় বছর ও আমাদের সময়ে ৬-৭ বছর কাজ করলেও আমি নিজে কোথাও সাংবাদিক পরিচয় দিই না। কিন্তু মনে মনে হয়তো সাংবাদিক রয়ে গেছি, সে কারণেই সাংবাদিক ছাঁটাইয়ের কথা শুনলে মন বিষণ্ন হয়। কিছুটা হয়তো ক্ষোভও জাগে।'
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে লেখাটি নেয়া। - মুক্তবাক