www.muktobak.com

গোপন বৈঠক, গোপন সংবাদের ভিত্তি ও জিহাদী বই


 আমীন আল রশীদ    ২৩ এপ্রিল ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:১৬    বইপত্র


(গণমাধ্যমের উপস্থাপনা, উপস্থাপনার ভাষা, খন্ডিত তথ্য পরিবেশন অথবা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় পক্ষপাতের কারণে সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনমনে নানাসময়ে দেখা দেয় আলোচনা সমালোচনা। পেশাদারিত্বের অভাব আর স্বার্থ কখনও কখনও একাকার হয়ে যায়; দেখা দেয় নানা বিভ্রান্তি। গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব আর সংবাদ পরিবেশনের নানা অসঙ্গতি নিয়ে সাংবাদিক ও লেখক আমীন আল রশীদের পাঠক নন্দিত বই "বাংলাদেশের গণমাধ্যশ : জনআস্থার দোলাচল"। বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে মুক্তবাকে। আজ পড়ুন ৫ম পর্ব।)

১০ আগস্ট ২০১৮ অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম: ‘ঝালকাঠিতে গোপন বৈঠকের সময় ৮ জামায়াত নেতা আটক।’ খবরে বলা হয়, ‘জেলা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান মিয়া জানান, পূর্ব চাঁদকাঠির মরিয়ম ম্যানশনের পঞ্চমতলার একটি ফ্লাটে ভাড়া থাকেন জেলা জামায়াতের সাংগঠনিক সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন। তার বাসায় সকালে বৈঠকে বসেন জেলার শীর্ষ জামায়াত নেতারা। সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং নাশকতার পরিকল্পনায় এ বৈঠক চলছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তার নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল অভিযান চালিয়ে বৈঠকে উপস্থিত আটজনকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। ঝালকাঠির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) এম এম মাহামুদ হাসান জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা বৈঠকের কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।’


এখানে ডিবি পুলিশ কর্মকর্তার ‘জানান’ এবং ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে’ শব্দগুলো ব্যাখ্যার দাবি রাখে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা দেখার চেষ্টা করি ‘গোপন বৈঠক’ বলতে কী বোঝায়? গোপন বৈঠক কারা করে? কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী বা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো রাজনৈতিক দল গোপন বৈঠক করে। কিন্তু ২০১৩ সালের পয়লা আগস্ট হাইকোর্ট একটি রিট পিটিশনের (নং ৬৩০/২০০৯) প্রেক্ষিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করলেও সরকার এই দলটিকে নিষিদ্ধ করেনি। অর্থাৎ জামায়াতের রাজনৈতিক তৎপরতা যেহেতু নিষিদ্ধ নয়, সুতরাং তাদের নেতাকর্মীরা যদি তাদের অফিসে কিংবা কোনো নেতার বাসায় বৈঠক করেন, তাহলে সেটি কোন অর্থে ‘গোপন’ হয়, তা পরিস্কার নয়। কেননা দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় অনেক দলই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নয়। শুধু জামায়াত নয়, ইদানীং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপির লোকজনকে আটকের পরও সাংবাদিকদের বলে, তাদের গোপন বৈঠকের সময় আটক করা হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা কেন গোপনে বৈঠক করবেন সেটি পরিস্কার নয়। বস্তুত এই ‘গোপন বৈঠক’ শব্দযুগল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে। তারা এরকম আরও অনেক শব্দ ব্যবহার করে। কিন্তু গণমাধ্যম কি হুবহু সেই শব্দগুলো প্রকাশ ও প্রচার করবে? অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গণমাধ্যমের ভাষা অভিন্ন হবে কি না?

প্রথম পর্ব পড়ুন : আগস্ট ট্র্যাজেডি এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম


‘ক্রসফায়ার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শব্দ দুটি বন্ধনীর ভেতরে রাখা হয়। অর্থাৎ ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধে যাদের মৃত্যু হয়, সেগুলো যে প্রশ্নাতীত নয় বরং সেগুলো যে আসলে একধরনের রাষ্ট্রীয় হত্যাকা-গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষ তা জানে। জানে বলেই গণমাধ্যম এই শব্দগুলো বন্ধনীর ভেতরে রেখে একধরনের দায়মুক্তি গ্রহণের চেষ্টা করে। কিন্তু গোপন বৈঠকের বেলায় তারা সেটি করে না। যেমন করে না ‘জিহাদী বই’ শব্দটি লেখার ক্ষেত্রে।

১৯ জুলাই ২০১৮ বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি সংবাদ শিরোনাম: ‘নাটোরে জিহাদী বইসহ তিন জেএমবি সদস্য আটক।’ খবরের বিবরণে বলা হয়,‘নাটোর সদর উপজেলার রুয়েরভাগ গ্রামে গোপন বৈঠক করার সময় তিন জেএমবি সদস্যকে জিহাদি বইসহ আটক করেছে র‌্যাব। আটককৃতরা হলেন, নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার মহারাজপুর গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে জাহিদুল ইসলাম (৩০),বড়াইগ্রাম উপজেলার গোনাইহাটি গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে আমজাদ হোসেন (৪২) এবং লালপুর উপজেলার চৌষডাঙ্গা গ্রামের মৃত গাজিউর রহমানের ছেলে জহির উদ্দীন (৪০)। র‌্যাব-৫ সিপিসি ২ ক্যাম্পে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মেজর শিবলী মোস্তফা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।’

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন:  সংবাদ সম্মেলন নিজেই যখন সংবাদ


প্রশ্ন হলো জিহাদী বইয়ের সংজ্ঞা কী? কোন ধরনের বইকে জিহাদী বই বলা হয়? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ যাবত যতগুলো কথিত জিহাদী বই উদ্ধার করেছে, সেগুলোর কি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তাদের কাছে আছে? অর্থাৎ উদ্ধারকৃত বইগুলোর ধরন কী, সেগুলোর লেখক কারা, বইয়ের ভেতরে কী আছে, প্রকাশক কারা, কোথা থেকে ছাপা হয় ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর কি গণমাধ্যম কোনোদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জানতে চেয়েছে? নাকি তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংবাদ সম্মেলনে যা বলে সেটিই প্রকাশ ও প্রচার করে? এক্ষেত্রে গণমাধ্যম কেন অধিকতর অনুসন্ধানে আগ্রহী হয় না? 
গুগলে ‘জিহাদী বই’ লিখে অনুসন্ধান করলে যেসব বইয়ের ছবি আসে সেখানে ‘কুরআনের কিছু গোপন রহস্য’, ‘কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যা’ ইত্যাদি নামের কিছু বইয়ের পাশাপাশি ‘আজকের জিহাদ আগামী জান্নাত’, ‘কিতাবুল জিহাদ’ ইত্যাদি বইয়ের ছবি আসে।

তৃতীয় পর্ব পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন


ইংরেজিতে ‘জিহাদি বুক’ লিখে অনুসন্ধান করলে বেশ কিছু বইয়ের নামের সঙ্গে জিহাদ শব্দটি দেখা যায়। যেমন Inside the Jihad, Jihad and Death: The Global Appeal of Islamic State, Jihadi Culture, The Ultimate Jihad, The Jihadi Return, Raising a Jihadi ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, এই সব বই কি জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে নাকি কথিত জিহাদের নামে বিভিন্ন জঙ্গি ও উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট উচ্চারণও রয়েছে?
লন্ডন থেকে প্রকাশিত প্রখ্যাত আইরিশ সাংবাদিক প্যাট্রিক ককবার্নের ‘দ্য রাইজ অব ইসলামিক স্টেট’ নামে একটি বই সংগ্রহ করি যেখানে জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর উত্থানের বিবরণ রয়েছে। এখন এই বইটিকেও কি জিহাদী বই বলা হবে এবং আমার কাছে জিহাদী বই আছে বলে অভিযোগ করা হবে? সুতরাং, বইয়ের নামের সঙ্গে জিহাদ শব্দটি যুক্ত থাকলেই কিংবা ধর্মীয় নামের বই হলেই সেটি জিহাদী বই এই ক্লিশে ধারণা থেকে বের হওয়া জরুরি। সম্ভবত আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও জিহাদী বই সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা রাখেন না। ফলে তারা কোনো জঙ্গি আস্তানা বা জামাত শিবিরের লোকদের কাছ থেকে ধর্মীয় নামযুক্ত কোনো বই পেলে বা তাদের সাংগঠনিক বইপত্র পেলেও সেগুলোকে জিহাদী বই উদ্ধার বলে দাবি করেন।

চতুর্থ পর্ব পড়ুন: গণমাধ্যম যেভাবে ‘জঙ্গি’ বানায়


আসা যাক ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে’। গোপন সংবাদ মানে কী? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেখানেই অভিযান যাক না কেন, কোনো না কোনো তথ্য বা সংবাদের ভিত্তিতেই যায় বলে ধরে নেয়া হয়। অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকটি অভিযানেরই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। তারা একজন আসামিকে ধরতে যাওয়ার আগেও তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে। বিভিন্ন স্থানে তাদের লোক থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে চৌকিদারসহ নানা সোর্স থাকে। তারাই পুলিশকে খবর দেয়। এখানে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। সুতরাং পুলিশের যেকোনো অভিযানই ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে’ হয় এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আলাদা করে সংবাদে এই শব্দ উল্লেখ করা হলে প্রেসবিজ্ঞপ্তি এবং সংবাদের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে ভাষায় সংবাদ সম্মেলনে কথা বলে বা প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠায়, গণমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করা। প্রশ্ন করার নামই সাংবাদিকতা।


আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন বলে তারা গোপন সংবাদে ভিত্তিতে অভিযান চালিয়েছে, এটি তাদের ভাষা। কিন্তু গণমাধ্যম এই শব্দগুলো বাদ দিয়েও সংবাদ লিখতে পারে। যেমন উপরে উল্লিখিত অভিযানের সংবাদটি এভাবে লেখা যায় ‘সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মেজর শিবলী মোস্তফা বলেন, বুধবার দিবাগত রাত দেড়টায় সদর উপজেলার রুইয়েরভাগ গ্রামে অভিযান চালিয়ে ওই তিনজনকে আটক করা হয়। তারা জেএমবি সদস্য বলে দাবি তার। আটককৃতদের কাছ থেকে কথিত জিহাদী বই, মোবাইল ফোন ও সিমকার্ড উদ্ধার করা হয়। এখানে ‘জিহাদী’ শব্দের আগে ‘কথিত’ শব্দটি ব্যবহার করলে গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব ঠিক থাকে এবং পাঠক-দর্শক-শ্রোতাকেও কোনো ধরনের বিকৃতি বা বিশেষণ ছাড়াই মূল তথ্যটি দেয়া যায়।


এবার আসা যাক ‘জানান’ প্রসঙ্গে। জানান, বলেন, দাবি করেন, উল্লেখ করেন কাছাকাছি। কিন্তু প্রত্যেকটির মধ্যে পার্থক্য আছে এবং সংবাদ লেখার ক্ষেত্রে এই পার্থক্য জানা জরুরি। জানান মানে somebody infomed অর্থাৎ কোনো তথ্য যার সত্যতা রয়েছে। যেমন, আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, সংসদের আগামী অধিবেশনেই সড়ক পরিবহন বিল তোলা হবে। বলেন মানে somebody said. যেমন আইনমন্ত্রী বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। দাবি করেন মানে Somebody Claimed. অর্থাৎ যেটি সত্য হতে পারে নাও হতে পারে। যেমন ‘পুলিশকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা গুলি ছোঁড়ে, পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে দুই সন্ত্রাসী নিহত হয়।’ এ জাতীয় ঘটনায় যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য সব সময় একইরকম থাকে, সুতরাং এখানে ‘পুলিশ জানায়’ না লিখে ‘পুলিশের দাবি’ লেখাই সঙ্গত। সুতরাং কোন ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা জানান, বলেন এবং দাবি করেন লিখবেন বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান সম্পর্কিত সংবাদে সেটি পরিস্কার থাকা দরকার। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের নিজস্ব স্টাইল বা নীতিও থাকা প্রয়োজন।

বই নিয়ে দেখুন চার সাংবাদিকের পাঠ প্রতিক্রিয়া :  




 আরও খবর