www.muktobak.com

কীর্তিমান এক সাংবাদিকের বিদায়


 মানব জমিন অনলাইন    ২৮ এপ্রিল ২০১৯, রবিবার, ৯:০০    স্মরণীয়


বাংলাদেশে পরিবেশ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও সময়ের সাহসী কণ্ঠস্বর মাহফুজ উল্লাহ আর নেই। থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ আন্তর্জাতিক হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল (২৭ এপ্রিল) বেলা ১১টা ৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। তার মেয়ে নুসরাত হুমায়রা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক স্টাটাসে মাহফুজউল্লাহ’র মৃত্যুবরণের সংবাদটি নিশ্চিত করেন। কিছুদিন ধরে হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি ও ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন কীর্তিমান এই সাংবাদিক। ২রা এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। স্কয়ারে কয়েকদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ১১ই এপ্রিল তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্যাংককে নিয়ে বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে ব্যাংককে একবার তার বাইপাস সার্জারিও হয়েছিল।

লেখক, সাংবাদিক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ও পরিবেশবিদ মাহফুজউল্লাহ ১৯৫০ সালের ১০ই মার্চ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।

তার পিতার নাম হাবিবুল্লাহ ও মায়ের নাম ফয়জুননিসা বেগম। ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত কমরেড মুজফফর আহমেদের দৌহিত্র। তার বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ। 

তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে ঊনসত্তরের ১১ দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়েনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্ররাজনীতির কারণে আইয়ুুব খানের সামরিক শাসনামলে তাকে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে পদার্থবিদ্যা ও ৭৪ সালে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। 

শিক্ষাজীবনেই মাহফুজ উল্লাহ সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের একসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার জন্মলগ্ন থেকেই এ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। মাঝে চীন গণপ্রজাতন্ত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে, কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপদূতাবাসে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে কাজ করেছেন তিনি। উপস্থাপনা করেছেন রেডিও ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান। সর্বশেষ তিনি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন। সাম্প্রতিক দশকে বাংলাদেশে টেলিভিশন টকশোর সাহসী ও আলোচিত কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি। 

মাহফুজউল্লাহ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একজন পরিবেশবিদ ছিলেন। তিনিই প্রথম পরিবেশ সাংবাদিকতা শুরু করেন বাংলাদেশে। তিনি সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার-এর আন্তর্জাতিক পরিচালনা পর্ষদের প্রথম বাংলাদেশী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। 

বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় মাহফুজউল্লাহ লেখা বইয়ের সংখ্যা ৫০ এর অধিক। তার সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ: আ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি; যাদুর লাউ; যে কথা বলতে চাই; অভ্যুত্থানের ঊনসত্তর; পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ জান্তা ও জনতা; পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন: গৌরবের দিনলিপি (১৯৫২-৭১); উলফা অ্যান্ড দ্য ইনসারজেন্সি ইন আসাম; বেগম খালেদা জিয়া: হার লাইফ হার স্টোরি; স্বাধীনতার প্রথম দশকে বাংলাদেশ; মুক্তজীবন রুদ্ধপ্রাণ; পাঠকের চোখে জাসদ; স্বরূপ অন্বেষা; এ কী কেবলই প্রেম। এসবের বেশিরভাগই পৃথিবীর বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে সংগৃহীত আছে। 

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে ঊনসত্তরের ১১ দফা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মাহফুজ উল্লাহ।

বাম রাজনীতি দিয়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু করলেও বেশ কয়েক বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন মাহফুজ উল্লাহ। যে কারণে তার বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসাবেও পরিচিতি রয়েছে।

রেডিও ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সরব উপস্থিতি ছিল মাহফুজ উল্লাহর। তাকে উপস্থাপনাও করতে দেখা গেছে।

আন্তর্জাতিকভাবে একজন সক্রিয় পরিবেশবিদ হিসাবে পরিচিত মাহফুজ উল্লাহ। সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নামক একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহফুজ উল্লাহ।

এছাড়াও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর করজারভেশন অব নেচারের আন্তর্জাতিক পরিচালনা পর্ষদের প্রথম বাংলাদেশি সদস্য তিনি।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৫০ এর অধিক বই লিখেছেন মাহফুজ উল্লাহ। বইগুলো আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিলাভ করেছে। বইগুলোর অধিকাংশই বিশ্বের বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে সংগৃহীত আছে।

তার লিখিত বইগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়া: রাজনৈতিক জীবনী, অভ্যুত্থানের ঊনসত্তর, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন: গৌরবের দিনলিপি (১৯৫২-৭১), উলফা অ্যান্ড দ্য ইনসারজেন্সি ইন আসাম, যে কথা বলতে চাই উল্লেখযোগ্য।




 আরও খবর