২০১৪ সালের ১০ আগস্ট। সময় সংবাদে যোগদানের মধ্য দিয়ে টেলিভিশন রিপোর্টিংয়ে হাতেখড়ি হল আমার। নতুন কর্মস্থল। কারো সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই। কার মানসিকতা কেমন সেটা বুঝে উঠতেও সময় প্রয়োজন। খুব সতর্কভাবেই চলছি আর একজন কাছের মামুষ খুঁজছি। এমন সময় জানলাম নিউজ এডিটর জাকারিয়া মুক্তা ভাই আমাদের উত্তরবঙ্গের।
আমার বাড়ি রংপুরে। মুক্তা ভাইয়ের বাড়ি নীলফামারি। পাশের জেলার মানুষ হলেও কোনদিন মুক্তা ভাইয়ের সাথে কথা হয়নি। কিভাবে কথা বলব, আমাকে কিভাবে গ্রহণ করবেন; অনেকটা ভয় ও দ্বিধা নিয়ে সামনে গেলাম। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলার আগেই বললেন, শাহীন, বলেন কি খবর? আগে কোথায় কাজ করেছেন। আমি অনেকটা অবাক হলাম। ইতোমধ্যে ভয় কেটে গেল। সব কিছুর পরিচয় দিলাম। মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনার পর হাসলেন। মিষ্টি হাসিটা এখনও আমার চোখে ভাসে।
সে দিনের মুক্তা ভাইয়ের মিষ্টি হাসিটা আমার জন্য যে কত বড় অনুপ্রেরণা ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। সেদিন মনে হয়েছে সময় টেলিভিশনে আমি একা না। আমার একজন আপন মানুষ আছেন। এরপর সবার সাথেই সম্পর্ক হল। দ্রুত ভাললাগার, ভালবাসার কর্মস্থল হিসেবে পরিণত হল সময় টেলিভিশন। মুক্তা ভাই না থাকলে হয়ত সময় টিভিতে এ্যাডজাস্ট হতে অনেক সময় লাগত। যেটি মুক্তা ভাই থাকার কারণে খুব দ্রুত সম্ভব হয়েছে।
এত গেল সময় টিভিতে এ্যাডজাস্টমেন্টের কথা। আমি রংপুরের ছেলে। ঢাকায় রংপুরের সাংবাদিকদের একটি প্ল্যাটফর্ম আছে যেটি আমি জানতামনা। বলছি রংপুর বিভাগ সাংবাদিক সমিতির কথা। এই সংগঠনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মুক্তা ভাই।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে এ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে নিউজ রুমে বসে আছি। হঠাৎ মুক্তা ভাই ডাকলেন। শাহীন এদিকে আসেন। আমি জ্বি ভাই বলে সামনে গেলাম। মুক্তা ভাই জিজ্ঞেস করলেন, আপনি রংপুর বিভাগ সাংবাদিক সমিতির সদস্য কি না? না বলাতেই ধমক দিয়ে বললেন তাড়াতাড়ি সদস্য হয়ে যান। মুক্তা ভাই বলেছেন, আর দেরি করলাম না সমিতির সদস্য হয়ে গেলাম। রংপুর বিভাগ সাংবাদিক সমিতির সদস্য হওয়ার পর পরিচয় হল আরো অনেক সাংবাদিকদের সঙ্গে।
আস্তে আস্তে সাংবাদিকতা পেশাটা নেশায় পরিণত হল। এক্ষেত্রে যার অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি হচ্ছেন মুক্তা ভাই। তিনি নতুনদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন না কিন্ত ছায়ার মত সবসময় থাকতেন। এটি বুঝতে পারলাম একটা বিপদে পড়ে। সঙ্গত কারণে বিপদের কথা উল্লেখ করতে পারলামনা। তবে ওই সময়টা খুব টেনশন করছি, চাপে থাকছি। কাজে তেমন মনযোগ দিতে পারছিনা।
কয়েকদিন ধরে এমন অবস্থা দেখে তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে ক্যান্টিনে চা খেতে গেলেন। আমি অবাক হলাম। যে মানুষটা নতুনদের কখনও এভাবে ডেকে চা খেতে যাননা। হঠাৎ আমাকে চা খেতে ডাকলেন। চা খেতে খেতে আমাকে বললেন, আপনি কি কোন সমস্যায় আছেন? আমাকে খুলে বলতে পারেন। আসলে আমি এমন একজনকে খুঁজছিলাম, যাকে আমি সমস্যা সব খুলে বলব। মুক্তা ভাইকে পাব ভাবিনি। সব খুলে বললাম। শুনে হাসলেন, বললেন এটা কোন সমস্যা, এটার জন্য আপনি চিন্তা করছেন। আমার বুক থেকে যেন একটা বড় পাথর সরে গেল। তারপর বিপদ উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত তিনি আমার পাশে ছিলেন।
আরেকটা কথা খুব মনে পড়ছে। আমার বানান ভুল হত। যখনই সময় পেতেন বানানের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে বললেন। এখন আমার বানান প্রায় শতভাগ শুদ্ধ মুক্তা ভাই। কথাটি কখনও জানানোর সুযোগ পেলামনা। কাছে থেকেও মুক্তা ভাইকে চিনতে পারিনি। যখন চিনলাম তখন আপনি বহুদূরে, না চেনাই ভাল ছিল তবে। আপনার মত মিষ্টি করে কেউ আর আপনি বলে ডাকবেনা। খুব মিস করব আদর জড়ানো ডাকটি। ওপারে ভাল থাকবেন, খুব ভাল থাকবেন শ্রদ্ধেয় মুক্তা ভাই।
লেখক : সাংবাদিক, চ্যানেল টুয়েন্টিফোর, রংপুর