www.muktobak.com

সাংবাদিকতায় মোবাইল ফোন


 অমৃত মলঙ্গী, দেশ রুপান্তর    ২৩ জুলাই ২০১৯, মঙ্গলবার, ১:৪৯    প্রশিক্ষণ


সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা গোটা পৃথিবীতে যখন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন মোবাইল নামের খুদে কম্পিউটার স্বস্তির পরশ। নাগরিক সাংবাদিকতার করিডর ছুঁয়ে পেশাদার সাংবাদিকের অন্যতম হাতিয়ার এটি। মোবাইল যুগের সাংবাদিকতার বিস্তারিত লিখেছেন অমৃত মলঙ্গী।

সাংবাদিকতার ভাষায় অনলাইন ব্যবহারকরীদের যাদের বেশিরভাগই গণমাধ্যমের গ্রাহক (পাঠক/দর্শক/শ্রোতা)। আধুনিক যুগের এই অডিয়েন্স নিজে কখনো সাংবাদিক হয়ে উঠছে (সেন্ডার), আবার কখনো সংবাদ গ্রহণ করছে। দুটি কাজেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে মোবাইল।

কুমিল্লার তনু হত্যাকাণ্ড থেকে সিলেটের সামিউল আলম রাজনের প্রতি নৃশংসতা; প্রতিটি ঘটনা ‘সংবাদ’ হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে এই মোবাইল। পত্রিকা কিংবা টেলিভিশনে আসার আগেই মানুষ ঘটনাগুলো জেনেছে, বিশ্বাস করেছে, আলোচনায় মেতেছে। এরপর শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো নড়েচড়ে বসেছে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সাংবাদিকতা রূপান্তরিত হয়েছে পেশাদার সাংবাদিকতায়।

সাধারণ মানুষ যখন তার বন্ধু তালিকায় থাকা কোনো ফেইসবুক ব্যবহারকারীর থেকে বিস্তারিত জানছেন, তখন পেশাদার সাংবাদিকদের চ্যালেঞ্জটা যাচ্ছে বেড়ে। ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার নতুন কোনো দিক আরও বিশ্বাসযোগ্য করে প্রচার করতে হচ্ছে তাকে।

কারণ, হাতের ওই মোবাইল সাধারণ মানুষকে একটি ঘটনা দ্রুত ‘বিশ্বাস’ করাচ্ছে। সাংবাদিককে সেই ‘বিশ্বাস’কে নতুন মাত্রা দিতে হচ্ছে অথবা ভিন্ন কোনো দিক বের করতে হচ্ছে।

কিছুদিন আগে এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক মোবাইল সাংবাদিকতা সম্মেলন হয়ে গেল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে। সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিল কনরাড এডেনাউর স্টিফটঙ্গ (কেএএস) মিডিয়া প্রোগ্রাম। তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে ৩০ জন স্পিকারকে পাওয়া গেল। একজনকে মেইল করে সম্মেলনের বিস্তারিত জানতে চাইলে তাকে দারুণ একটি শব্দ ব্যবহার করতে দেখা গেলÑ ‘এক্স ফ্যাক্টর’। তিনি বোঝাতে চাইলেন সাংবাদিকতায় এখন মোবাইল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভবিষ্যতে এটি ছাড়া এই পেশা কল্পনা করা যাবে না!

চমকে ওঠার মতো বিষয়। সাংবাদিকতায় মোবাইলের ব্যবহার অপরিহার্য, আজ থেকে ১০ কিংবা ২০ বছর আগেও সেটি কেউ বলতেন না। কিন্তু এখন কেন এই পেশার মানুষরা এমনটি বলছেন? এর কারণ হাতের মুঠোয় থাকা এই খুদে কম্পিউটার সাংবাদিকতার সব মৌলিক কাজ আরও সহজ ও নিখুঁত করে দিচ্ছে। উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে ব্যবহারকারী। এখন অনেকে টাইপিংয়ের জন্য কম্পিউটারও ব্যবহার করছেন না, মুখ দিয়ে বলছেন আর মোবাইল সেটি লিখে ফেলছে!

সম্মেলনের স্পিকার ফিলিপাইনের নারী সাংবাদিক আনা পুওদের কাছে এই সাংবাদিকতার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে দেশ রূপান্তরকে মেইলে এভাবে তিনি উত্তর দেন, ‘মোবাইল সাংবাদিকতা এখন এক্স-ফ্যাক্টর। ভবিষ্যতে এটি ছাড়া নিজেদের অচল মনে হবে। আমার দেশে ৭০ মিলিয়ন নাগরিক মোবাইল ব্যবহার করেন। নেটওয়ার্ক কোম্পানি তাদের অধিকাংশ সময় ফ্রি ডেটা দেয়। তা দিয়ে অনেকে সংবাদ পড়েন। শুধু ফিলিপাইন নয়, এশিয়াসহ গোটা পৃথিবীতেও একই অবস্থা। যতদূর জানি বাংলাদেশেও কোটি কোটি মানুষ অনলাইনে থাকেন। বিশাল এই অডিয়েন্সের জন্যই সাংবাদিকতায় পরিবর্তন আসছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের চ্যালেঞ্জও বাড়ছে। কারণ মানুষ ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সব জেনে যাচ্ছে। আবার তাকে সেটি জানাতে হচ্ছে আমাদের। এ ক্ষেত্রে কাজের বৈচিত্র্য না থাকলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন। ঠিক এ কারণে মোবাইল সাংবাদিকতায় আপনাকে প্রশিক্ষণ নিতেই হবে। প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে।’

আনা জানান, সদ্য শেষ হওয়া সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের জন্য ১১টি ওয়ার্কশপ রাখা হয়। সেই ওয়ার্কশপের কিছু তথ্য এবং মোবাইল জার্নালিজমবিষয়ক একটি ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া কিছু কারিগরি নির্দেশনা নিচে তুলে ধরা হলো

স্মার্টফোন কোয়ালিটি

একজন সাংবাদিকের কাছে মোবাইল হচ্ছে ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। একটি যন্ত্র দিয়ে আপনি ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন, ভয়েস দিচ্ছেন, এডিট করছেন। এতসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পেশাদার মানুষের কমদামি মোবাইল ব্যবহার করা ঠিক নয়। কমপক্ষে আপনার ফোন ১০৮০ পিক্সেলের হওয়া দরকার। প্রসেসরও হতে হবে ভালো।

আইফোনের ক্ষেত্রে আইফোন-৬কে উপযোগী বলা হয়। অ্যান্ড্রয়েডের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড যেমন স্যামসাং, এলজি, গুগল পিক্সেল অথবা ওয়ানপ্লাস ব্যবহার করতে পারেন। ফোনে ৩.৫ মিমি হেডফোন অথবা ৩.৫ মিমি অ্যাডাপ্টর স্টক আছে কি না, সেটিও দেখে নিতে হবে। এসব ছাপিয়ে আপনার মোবাইল সম্পর্কে আপনার আদ্যোপান্ত ধারণা থাকতে হবে। কীভাবে কোন ফাংশন অপারেট করতে হয়, সেটি জানতে হবে।

 লেন্স কোয়ালিটি

সস্তা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের লেন্স পর্যাপ্ত নয়। এতে যে ছবি এবং ভিডিও ধারণ হয় তাকে সংবাদ প্রকাশের উপযোগী বিবেচনা করা হয় না। তাই বলে ডুয়েল লেন্সও দরকার নেই। আইফোন এবং শীর্ষস্থানীয় অ্যান্ড্রয়েড ফোন হলেই চলবে। এই ফোনে এইচডি ভিডিও এবং হাই-রেজ্যুলেশন ছবি ক্যাপচার করা যায়।

ক্যাপচার

কাঁপা-কাঁপা ভিডিও অপেশাদারিত্বের পরিচয়। এই সমস্যা এড়াতে ট্রাইপড ব্যবহার করা উচিত। যদি আপনার ফোনে অপটিক্যাল ইমেজ স্ট্যাবিলেশন (ওআইএস) থাকে, তবে সেটি অন করুন। যদি না থাকে তবে ‘ঋরষসরপ চৎড়’ ঘরানার অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন। এই সমস্যা এড়াতে আপনি অজমো ক্যামেরাও ব্যবহার করতে পারেন। এটি পরিষ্কার ছবি এবং ভিডিও তুলতে সাহায্য করে।

অডিও

মোবাইলের সাধারণ মাইক্রোফোন হাই-কোয়ালিটি অডিও রেকর্ড করতে পারে। কিন্তু অডিও কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যায় তখন, যখন আপনার সাবজেক্ট ফোন থেকে দূরে অবস্থান করে। এসব ক্ষেত্রে এক্সটারনাল মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে হবে। এড়িয়ে যেতে হবে বেশি বাতাস। বাতাসের দিনে যদি আউটডোরে রেকর্ড করেন, তাহলে মাইক্রোফোনে উইন্ডশিল্ড ব্যবহার করুন।

 ফ্রেম

এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রেমিং মূলত আপনার সাধারণ বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। এখানে মেধার পরিচয় দিতে হবে। আপনি কীভাবে, কোন অ্যাঙ্গেলে কয়টি সাবজেক্ট ক্যাপচার করবেন, সেটি আগে ঠিক করতে হবে। আপনার ছবি কিংবা ভিডিও ধারণ করার সময় ফ্রেমে কী কী রাখবেন, সেটি আপনার কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে। অযথা বাড়তি মানুষের উপস্থিতি দর্শকের কাছে বিরক্তিকর মনে হতে পারে। আবার যিনি কথা বলছেন, তার মাথা দেখা যাচ্ছে না কিংবা এক কান দেখা যাচ্ছে না; এমন যেন না হয়। পরিষ্কার একটি ফ্রেম নেওয়ার চেষ্টা করুন।

 লাইট

কম আলোতে স্মার্টফোন লেন্স বেশ বিপাকে পড়ে যায়। উন্নত স্মার্টফোন এ ক্ষেত্রে বেশ ভালো। তবু এগুলো দিয়ে এখনো টিভির জন্য কম আলোতে লাইভ করা কষ্টকর। তাই যদি সম্ভব হয়, তবে পর্যাপ্ত আলোতে কাজ করার চেষ্টা করুন। ইনডোরে থাকলে জানালার পাশে চলে যান। সাবজেক্টের মুখে যেন আলো পড়ে, সেটি নিশ্চিত হয়ে নিন।

ছবি তোলার ক্ষেত্রে এখন দারুণ সব অ্যাপ পাওয়া যায় গুগল প্লে-স্টোরে। পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য এগুলো দরকারি। ব্যবহার করতে পারেন প্রো ক্যামেরা (আইওএস) অ্যাপ। হাই কোয়ালিটি ছবি তুলতে এবং ভিডিও ধারণ করতে এটি খুব কার্যকর। এটি ব্যবহার করার উপায় ওয়েবসাইটের টিউটোরিয়ালে দেওয়া আছে।

 আরও কয়েকটি অ্যাপ

snapspeed,  ProShot, VSCO

 শট টাইপ এবং অ্যাঙ্গেল

আপনি কীভাবে শট নেবেন এটি প্রথমত আপনার সৃজনশীলতার ওপর নির্ভর করে। তার সঙ্গে প্রশিক্ষণের কিছু বিষয় আছে। যেটি সৃজনশীলতাকে আরও নিখুঁত করে।মানুষের চোখ সবকিছু ‘ওয়াইড’ অ্যাঙ্গেলে দেখে। তাই কাজ শিখতে শুরুতে আপনার অনেক ওয়াইড অ্যাঙ্গেল শট নেওয়া উচিত। এরপর কাজে বৈচিত্র্য আনতে ক্লোজআপ শট নিতে হবে, যা ভিডিওকে করবে আরও জীবন্ত।

 অতিরিক্ত ওয়াইড

এটি সাধারণত শুরুতে নিতে হয়। বেশ দূর থেকে। পুরো সাবজেক্ট ধারণ করতে হবে। যাকে ‘এস্টাব্লিশিং শট’ও বলে। এটি দেখে দর্শকরা বুঝতে পারেন, আপনার স্টোরি কোথা থেকে শুরু হচ্ছে।

 ওয়াইড

এটিও শুরুর দিকে নিতে পারেন। কোনো ব্যক্তির শুট করতে থাকলে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখাতে হবে।

 কাউবয়

ব্যক্তির মাথা থেকে হাঁটু পর্যন্ত শট। এরপর রয়েছে মিডিয়াম (কোমর পর্যন্ত), মিডিয়াম ক্লোজআপ (চিবুক পর্যন্ত), ক্লোজআপ (থুতনি পর্যন্ত)।

 এক্সট্রিম ক্লোজআপ

এটি মূলত নির্দিষ্ট একটি স্থানকে বোঝায়। সেটি ব্যক্তির চোখ হতে পারে। অথবা স্টোরির প্রয়োজনীয়তা অনুসারে অন্য কোনো অংশ।

 সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে শট নিতে হবে। শুরুতে টু-শট। অর্থাৎ উপস্থাপক কিংবা দুজন ব্যক্তিসহ শট। যেখানে উভয়কে দেখা যাবে।

 কাঁধ থেকে

সাবজেক্টের পেছন থেকে ক্লোজে ক্যামেরা ধরা। চুল থেকে দেখা যাবে।

 আই লাইন

যিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, তিনি কোথায় তাকাবেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় সরাসরি লেন্সে তাকালে সেটি অদ্ভুত মনে হয়। চোখের পাতা বারবার ফেললেও এমনটি হয়। যাকে ‘ফলস লুক’ বলা হয়।

ক্যামেরা অনেক দূরে রাখলে সাক্ষাৎকারদাতা কিছুটা নিঃসঙ্গ অনুভব করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তার অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হতে পারে তিনি নিজের ভেতর নেই। এক্ষেত্রে ক্যামেরা বিভিন্ন পজিশনে রাখতে পারেন। তবে খুব নিচু নয়। আবার খুব উঁচুতে নয়।

 এডিটিং

সম্পাদনা সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান শর্ত। আপনি লাইভে থাকলে ভিন্ন কথা। তখন ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সম্পাদনা ছাড়াই বরং ভালো হয়। কিন্তু ঘটনার পরে আপনি যখন সংবাদ প্রকাশ করবেন, তখন সম্পাদনা আপনাকে করতেই হবে।

ভিডিও সম্পাদনা করার সহজ একটি অ্যাপ হচ্ছে Quik। আইফোন হলে iMovie ব্যবহার করতে পারেন। এটি বেশ জনপ্রিয়। এই দুটি অ্যাপই বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। 

সাংবাদিকতায় মোবাইল ফোন  নিবন্ধটি ১৩ জুলাই দেশ রুপান্তরের ক্লিক পাতা হতে নেয়া।  এবিষয়ে আরো লেখা ছাপা হবে মুক্তবাক ডটকম এ। - মুক্তবাক

 




 আরও খবর