করাচীর পল্টন জীবনে (১৯১৭-২০) কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রকৃত সাহিত্য সাধনার সূত্রপাত।তার বাউণ্ডলের আত্মকাহিনী, মুক্তি, স্বামীহারা, কবির সমাধি, তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা, হেনা, আশায় লেখা। ঐ সময়ে এগুলো পল্টন থেকে কলকাতার প্রবাসী (১৯০০), সওগাত (১৯১৮), বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি প্রত্রিকা (১৯১৮) ও নূর (১৯২০) পত্রিকায় প্রেরণ করেন এবং যথারীতি ছাপা হয়। এসব পত্রিকাসহ অন্যান্য পত্রিকায়ও তিনি আরো অনেক লেখা প্রেরণ করেন।কিন্তু প্রকাশ অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় সেগুলো ছাপানো হয়নি। লেখালেখি সূত্রে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন (১৮৮৮-১৯৯৪) ও মুজাফফর আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩) প্রমূখ সম্পাদকের সঙ্গে লেখকরুপে তার পরিচিতি গড়ে ওঠে।পরে কলকাতায় এসে তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) শেষে বাঙালী পল্টন ভেঙে দিলে (মার্চ, ১৯২০) তিনি কলকাতায় চলে আসেন। এখানে বন্ধু শ্রীশৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের (১৯০১-৭৪) সঙ্গে তার বোর্ডিং এ (রমাকান্ত বোস স্ট্রীট পলিটেকনিক ইন্সটিউট) তিন চার দিন থেকে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির (১৯১৩) অফিসে (৩২ কলেজ স্ট্রীট) গিয়ে ওঠেন। সেখানে পূর্ব থেকেই মুজফফর আহমদ, মোহাম্মদ আফজাল-উল হক (১৮৯১-১৯৭০) ও কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৬-১৯৭০)বাস করছিলেন। এখানকার সাহিত্যিক পরিবেশ তার ভবিষ্যৎ জীবনের গতিনির্ধারণে ভূমিকা পালন করে। বিশেষতঃ মুজফফর আহমদের পরামর্শে তিনি অন্য কোনো চাকরি না খুঁজে লেখালেখিতে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন।
ঐ বছরেরই ২৪ মে (বৈশাখ, ১৩২৭) হতে মোহাম্মদ আফজাল উল হক মোসলেম ভারত নামে একটি সচিত্র মাসিক পত্র প্রকাশ শুরু করেন।তাতে সম্পাদকরুপে মোজাম্মেল হকের (১৮৬০-১৯৩৩)নাম মুদ্রিত হলেও এবং পত্রিকার সম্পাদকীয় ঠিকানা ৩, কলেজ স্কয়ার লেখা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে মোহাম্ম আফজাল উল হকই তার মেসে এর সম্পাদনা কাজ করতেন। মুজফফর আহমদ এ সম্পর্কিত স্মৃতিচারণায় লিখেছেন,ওই বাড়ীতে আফজালুল হক সাহেবের বড় তখ্ত পোশখানাই ছিল মোসলেম ভারতের অবিজ্ঞাপিত সম্পাদকীয় দপ্তর।
এখান থেকেই নজরুল সর্বপ্রথম মুদ্রণ সংক্রান্ত বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করে থাকবেন। এ পত্রিকার শুরু থেকেই তাকে লেখার অনুরোধ করা হয়। করাচীতে আংশিক লিখিত তার পত্রোপন্যাস বাঁধনহারা (গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯২৭) এ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে। অন্যান্য সংখ্যায় তার খেয়াপারের তরণী (৪র্থ সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩২৭), কোরবানী (৫ম সংখ্যা, ভাদ্র ১৩২৭),মোহররম (৬ষ্ঠ সংখ্যা, আশ্বিন ১৩২৭) প্রভৃতি কবিতা ও গান প্রকাশিত হলে তার কবিখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০-১৯২২)শুরু লগ্নে ঐ আন্দোলনের বহ্নিরাগ বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে ও নিজেদের মতামত তুলে ধরতে এ কে ফজলুল হকের (১৮৭৩-১৯৬২)স্বত্তাধীনে পরিচালিত সান্ধ্য দৈনিক নবযুগে (১২ জুলাই ১৯২০) মুজফফর আহমদের সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদকরুপে নজরুল যোগদান করেন। প্রকৃতপক্ষে মুজফফর ও নজরুলই ছিলেন এ পত্রিকার প্রধান উদ্যোক্তা।এ পত্রিকায়ই নজরুলের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। মুজফফর আহমদ অবশ্য এর পূর্বে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সহ সম্পাদক ছিলেন।
পত্রিকায় কাজ করার আনন্দ, অভিজ্ঞতা ও তাতে ইচ্ছে মতো লেখা প্রকাশের সুযোগ তাকে সাংবাদিকতার পেশায় আগ্রহী করে তোলে, কিংবা বলা যায় জীবিকা অর্জনের চেয়ে চিন্তা ভাবনা প্রকাশের নেশা বা একই সঙ্গে জীবিকা অর্জন ও চিন্তা ভাবনা প্রকাশের জন্যেই তিনি সাহিত্যসহ সাংবাদিকতাকে পেশারুপে গ্রহণ করেন।স্মর্তব্য, এ সময় তিনি তারুণ্যে টগবগ, ভবিষ্যতে আস্থাশীল, স্বপ্নমুখর ও আদর্শবাদী।অবশ্য উত্তরকালেও তার এ বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন ছিলো।
সাহিত্যিক প্রতিভার মতো তাঁর সাংবাদিক প্রতিভাও অনেকটা সহজাত। রাইটিং, রিপোর্টিং, সিলেক্টিং, কাটিং, সেটিং বা মেকআপ,প্রুফরিডিং, নিউজ এরেঞ্জমেন্ট, কপি এডিটিং, সাব এডিটিং বা এডিটিং প্রভৃতি কর্মকৌশল তিনি সাংবাদিকতার শুরু থেকেই প্রয়োগ করতে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে সম্পাদকীয় লিখনে ও সংবাদ পরিবেশনে তিনি নতুন রীতির প্রবর্তন করেন। তার সাংবাদিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সাংবাদিকতার নৈতিকতার () প্রতি একনিষ্ঠতা। বিশেষতঃ তার সম্পাদিত ্ও পরিচালিত প্রত্রিকাগুলো অন্বীক্ষা করলে আমরা এ সত্যের সাক্ষাৎ পাবো।
নজরুলের পত্রিকা ও তাতে তার অবস্থানের রেখাচিত্র এরকম :
১৯২০ :নবযুগ, সান্ধ্য দৈনিক : যুগ্ম সম্পাদক, লেখক
১৯২১ : মোহাম্মদী, দৈনিক ও সেবক, দৈনিক : সাংবাদিক, লেখক
১৯২২ : ধূমকেতু, অর্ধ সাপ্তাহিক :স্বত্বাধিকারী, সম্পাদক ও লেখক
১৯২৫ : লাঙল, সাপ্তাহিক :প্রধান পরিচালক, লেখক
১৯২৬ : গণবাণী, সাপ্তাহিক : সাংবাদিক, লেখক
১৯২৭ : সওগাত, সাপ্তাহিক, মাসিক, বার্ষিক : সাংবাদিক, লেখক
১৯৪১ : নবযুগ, দৈনিক : প্রধান সম্পাদক, লেখক
★ নজরুল ইন্সটিটিউট প্রকাশিত "নজরুলের সাংবাদিকতা" গ্রন্থ হতে নেয়া।