আবুল মনসুর আহমদ একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও আইনজ্ঞ ছিলেন। ব্যঙ্গ-রচয়িতা হিসেবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবস্থান যেমন সুনির্দিষ্ট, তেমনি সাংবাদিক হিসেবে তিনি বিভাগপূর্ব বাংলার একজন অভিভাবক-পুরুষ হিসেবে গণ্য। চল্লিশের দশকে তিনি ‘লীগ এগেইনস্ট মোল্লাইজমে’র মতো সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ-সমাজকে তথাকথিত মোল্লা মৌলবিদের হাত থেকে রক্ষা করে প্রগতিশীলতার পথে আনতে চেয়েছিলেন, আর এর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল তাঁর সাংবাদিকতা। উনিশ শতকের শেষার্ধে এসে কতিপয় মুসলিম নেতার প্রচেষ্টায় মুসলমানদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে বৃটিশ-সহযোগী মনোভাবে রূপান্তরিত হয় এবং রাজনীতি-অর্থনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাদের মধ্যে একটা জাগরণের সৃষ্টি হয়। এই জাগরণ চলে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। এই জাগরণের প্রাণশক্তি ছিল সংবাদপত্র। সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে এই প্রেক্ষাপটে সাংবাদিক-জগতে আবুল মনসুর আহমদের আবির্ভাব।
আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিক-জীবনের শুরু ১৯২৩ সনে এবং মাঝে কিছুদিন বাদ দিয়ে তা চলে ১৯৫০ সন পর্যন্ত। দীর্ঘ পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চাকরিসহ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি সাপ্তাহিক মুসলিম জগৎ, সাপ্তাহিক ছোলতান (১৯০২, ১৯২৩), সাপ্তাহিক মোহাম্মদী (মাসিক-১৯০৩, সাপ্তাহিক-১৯০৮), সাপ্তাহিক দি মুসলমান (১৯০৬), সাপ্তাহিক খাদেম (১৯২৯), দৈনিক নবযুগ (১৯৪১) পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং দৈনিক কৃষক (১৯৩৮) ও দৈনিক ইত্তেহাদ (১৯৪৭) পত্রিকায় প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ছোটবেলা থেকেই আবুল মনসুর আহমদের সাধ ছিল একজন বড় সাহিত্যিক হওয়ার। ক্লাস টু-তে পড়ার সময় তিনি হাতে লিখে ‘মঞ্জুষা’ নামক একটা মাসিক পত্রিকা বের করেন। আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছিলেন এর যৌথ সম্পাদক। বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে পছন্দমতো লেখা নকল করে মাত্র ২/৩টি সংখ্যা বের করতে পেরেছিলেন। ১৯১৩ সনে তিনি প্রবাসী পত্রিকার গ্রাহক হন এবং সবুজপত্রও নিয়মিত পড়তেন। ১৯১২-১৩ সনের দিকে ‘আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা’র মুখপত্র মাসিক আল ইসলাম পত্রিকায় ওয়াশিংটন আর্ভিং এর ‘টেলস্-অব-আল-হাম্রা’ গ্রন্থের অংশবিশেষের অনুবাদ করে ছাপানোর জন্য পাঠান এবং ছাপা হয়। ১৯১৮-২০ সালের মধ্যে মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকায় কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয় ‘গোলামী সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধ। তিনি এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করায় সাহিত্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
১৯২৩ সনে তিনি চাকরির উদ্দেশে কলকাতায় আসেন এবং ১৯২৯ সন পর্যন্ত কয়েকটি পত্রিকায় চাকরি করে ময়মনসিংহে ফিরে যান। জীবিকার তাগিদেই ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় এসে বাল্যবন্ধু আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক মুসলিম জগৎ পত্রিকায় পেটে-ভাতে কাজ শুরু করেন। ১৯২৩ সালে এই ‘মুসলিম জগত’ পত্রিকায় ‘ছহি বড় সোনাভানের’ অনুকরণে ‘ছহি বড় তৈয়বনামা’ নামে একটি স্যাটায়ার কাব্য এবং ‘সভ্যতার দ্বৈত শাসন’ নামে রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখে তৎকালীন মুসলিম সাংবাদিকদের নজরে পড়েন। এই স্যাটায়ার কাব্যটিই আবুল মনসুর আহমদের প্রথম ব্যঙ্গ রচনা।
উদীয়মান সাংবাদিক-পরিচিতি ও আবুল কালাম শামসুদ্দীনের প্রচেষ্টায় মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সাপ্তাহিক ছোলতান পত্রিকায় ত্রিশ টাকা বেতনে সহ-সম্পাদকের চাকরি পান আবুল মনসুর আহমদ। এই পত্রিকার আরেক মালিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সঙ্গেও তিনি কাজ করেন। এখানে দেড় বছর চাকরি করেন। ১৯২৩ সনের এপ্রিল মাসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উদ্যোগে ঐতিহাসিক ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ সম্পাদিত হলে সাংবাদিক হিসেবে এর সমর্থন করেন এবং ছোলতান পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন।
১৯২৪ সনের জুন-জুলাই মাসে মওলানা আকরম খাঁর সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকায় পঞ্চাশ টাকা বেতনে চাকরি পান। এ পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার গুরু ছিলেন মওলানা আকরম খাঁ, ফজলুল হক সেলবর্সী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও আলী আহমদ ওলী ইসলামাবাদী। এঁদের কাছ থেকে তিনি হাতে-কলমে সাংবাদিকতার জটিল পাঠ নিয়েছেন। এই সাপ্তাহিক পত্রিকায় সপ্তাহে দুটো করে মাসে মোট আটটি সম্পাদকীয়ের মধ্যে পাঁচ-ছয়টিই তিনি লিখতেন। এমনকি এসব সম্পাদকীয় তৎকালীন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রিডিংরুমে একজন আবৃত্তির ভঙ্গিতে পড়তেন ও অন্যরা শুনতেন। ‘মোহাম্মদী’তে তিনি দেড় বছরেরও অধিক সময় চাকরি করেন।
এরপর মৌলবি মুজিবর রহমানের দি মুসলমান পত্রিকায় চাকরি পান। দীর্ঘ চার বছর তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে এই ইংরেজি পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯২৮ সনে প্রজাস্বত্ব আইনের প্রশ্নে দলমত-নির্বিশেষে আইন-পরিষদের হিন্দু-সদস্যরা জমিদারদের পক্ষে ও মুসলিম-সদস্যরা প্রজাদের পক্ষে ভোট দেয়ায় আইনসভা সাম্প্রদায়িক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ১৯২৯ সনে আবুল মনসুর আহমদের মতো মুসলমান কংগ্রেসিরা মিলে মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস বর্জন করে নিখিল-বঙ্গ প্রজা সমিতি গঠন করেন।
মৌলবি মুজিবর রহমান তাঁর কাজের প্রতি এমন বিশ্বস্ত ও সন্তুষ্ট ছিলেন যে, তিনি খাদেম নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে তাঁকে সম্পাদন-পরিচালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেন এবং বেতন বাড়িয়ে করেন পঁচাশি টাকা। অত্যন্ত দক্ষতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে তিনি এ-পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ইতোমধ্যে সাংসারিক টানাপোড়েনে সাংবাদিকতা ছেড়ে ওকালতি করার সিদ্ধান্ত নেন। মৌলবি মুজিবর রহমান তাঁকে ফেয়ার ওয়েল দেন এবং এতে স্যার আব্দুর রহিম, মওলানা আবুল কালাম আযাদ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, ডা. আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা আকরম খাঁ, মৌলবি আব্দুল করিম, নবাব মশাররফ হোসেন, খান বাহাদুর আযিযুল হকসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। ১৯২৯ সনের ডিসেম্বর মাসে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে ওকালতি করার জন্য ময়মনসিংহে চলে যান।
১৯২২ থেকে ১৯২৯ সন পর্যন্ত এই আট বছরে লেখা কয়েকটি ব্যঙ্গগল্প সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং এই গল্পগুলো সংকলিত করে ১৯৩৫ সনে তাঁর বিখ্যাত আয়না গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এসময় ‘সওগাত’ অফিসে মুসলিম সাহিত্যিকদের নিয়মিত আড্ডা হত। ‘কাজী নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী, মোহাম্মদ বরকতুল্ল¬াহ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, হাবিবুলল্লাহ বাহার, কবি মঈনুদ্দীন, কবি ফজলুর রহমান, কবি বেনজির আহমদ, কবি মহীউদ্দিন প্রভৃতি সমস্ত সাহিত্যিকদেরই ‘সওগাত’ অফিসের আড্ডায় যাতায়াত ছিল।’
১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি’র উদ্যোগে কৃষক-প্রজা আন্দোলনের মুখপত্ররূপে ‘দৈনিক কৃষক’ পত্রিকা বের হয় এবং এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় অল্প কয়েকদিনেই পত্রিকাটি সাংবাদিক মহলে সম্মান ও সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আদর্শ নিষ্ঠায়, স্বাধীন মতবাদে এবং নিরপেক্ষ সমালোচনায় ‘কৃষক’ বেশ নাম করেছিল। ঐ সময় হক মন্ত্রীসভায় প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা বিল নিয়ে পত্রিকাগুলোতে বিতর্ক শুরু হয়। এই বিল অনুযায়ী মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার কর্তৃত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছাড়া হয়ে যাবে। এই বিলের বিরুদ্ধে সমস্ত পত্র-পত্রিকা অবস্থান নিলেও আবুল মনসুর আহমদ তাঁর সম্পাদকীয়তে এই প্রস্তাবের সমর্থন করেন। ফলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্যের এক পর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করেন।
১৯৪১ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকা বের করেন এবং সম্পাদকের দায়িত্ব দেন আবুল মনসুর আহমদের ওপর, কিন্তু আবুল মনসুর আহমদ এ-দায়িত্ব নিতে সম্মত হলেন না। অবশেষে কাজী নজরুল ইসলামকে সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় কিন্তু সব কাজ করতেন আবুল মনসুর আহমদ। তিনি তাঁর ‘আত্মকথা’য় এটিকে ‘বেনামী সম্পাদক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা জীবনের শেষ পর্ব শুরু হয় দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৭ সনের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ পত্রিকা প্রকাশিত হলে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। এ সময় তিনি আলীপুর জজকোর্টের ওকালতি ছেড়ে মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে দৈনিক ইত্তেহাদে সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি তাঁর ‘আত্মকথা’য় বলেছেন, ‘আমার গোটা সাংবাদিক জীবনের মধ্যে এইটাই আমার সবচেয়ে সুখ, আরাম ও মর্যাদার মুদ্দত ছিল।’ দীর্ঘ পঁচিশ বছরের সাংবাদিক জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে এই পত্রিকাকে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে এসেছিলেন এবং তার ফলে এটি সমকালের শ্রেষ্ঠতম দৈনিকে পরিণত হয়। ঐ সময়ে কোনো মুসলমান যুবক পত্রিকায় চাকরি পেত না।
আবুল মনসুর আহমদ বেছে বেছে মুসলমান যুবকদের পত্রিকায় চাকরি দিয়ে সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। ‘সাংবাদিকতায় তিনিই হাতেখড়ি দেন পরবর্তীকালের প্রখ্যাত সাংবাদিক মানিক মিয়া, কাজী মোঃ ইদরিস, তালেব রহমান, খোন্দকার হামিদ, রশীদ করিম, কবি আহসান হাবিব, রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই) প্রমূখের। এর মূলে ছিল তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্ব ও শক্তিশালী কলম। তার সাথে যোগ হয়েছিল নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, পরিশ্রম, বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতা।’ এই পত্রিকা বাংলার তরুণ মুসলমানদের চিন্তাজগতে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পত্রিকাকে আরো গতিশীল করবার জন্য ‘একনজর’ ও ‘পাঠকের মজলিস’ নামে পৃথক দুটো বিভাগ খোলেন। এভাবে এক বছর পুরো হওয়ার বহু আগেই ‘ইত্তেহাদ’ অফিস বাংলার মুসলিম চিন্তানায়কদের পীঠস্থানে এবং ‘ইত্তেহাদ’ মুসলিম-বাংলার প্রগতিবাদীদের মুখপত্রে পরিণত হয়।
১৯৪৭ সনের দেশবিভাগের পর সবাই ঢাকায় চলে আসলেও আবুল মনসুর আহমদ কলকাতায় থেকে যান। হিন্দুরা পূর্ব-বাংলা ত্যাগ করে পশ্চিম-বাংলায় ও মুসলমানরা পশ্চিম-বাংলা ত্যাগ করে পূর্ব-বাংলায় যাওয়ার হিড়িক পড়লে এবং উভয় বাংলায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হলে তা প্রতিরোধে তিনি পশ্চিম-বাংলার রাষ্ট্রনেতা-সাংবাদিক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে একযোগে কাজ করেন। সেখানে থেকেই তিনি ইত্তেহাদের মাধ্যমে ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পুর্ব-পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে ইত্তেহাদের প্রবেশকে নিষিদ্ধ করে। এসব সত্ত্বেও কলকাতার বুকে পাকিস্তানের সমর্থক মুসলিম-পত্রিকা চালানো তিনি সমীচীন মনে করলেন না এবং ঢাকায় স্থানান্তরের চেষ্টা করলেন। ঢাকায় স্থানান্তরের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও সরকারের অসহযোগিতায় তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫০ এর প্রথমদিকে ইত্তেহাদের অপমৃত্যু ঘটে এবং তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। এভাবেই আবুল মনসুর আহমদের দীর্ঘ পঁচিশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের অবসান হয়। এরপরে তিনি শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখেছেন এবং তা জীবনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বিশ শতকের ষাট ও সত্তর দশকে তিনি ছিলেন ‘গ্যালারির একজন সচেতন দর্শক’ বা ‘রাজনীতির হরিঠাকুর’।
মূলত অসহযোগ আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনসহ এ-দেশের অর্ধ-শতাব্দীব্যাপী সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে আবুল মনসুর আহমদের ভূমিকা ছিলো কখনও সক্রিয় কর্মীর, কখনও নেতার, কখনও পরামর্শদাতার এবং সেদিক থেকে তাঁর সব লেখাই তাঁর রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও মতাদর্শের একটা অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৃটিশ শাসনের শেষাংশের উত্তাল সময়, পাকিস্তান আমলের পুরোটা অংশ, আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও তার পরবর্তী কিছু অংশ। ইতিহাসের এই তিন কালকে তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কখনো কখনো ইতিহাসের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পরিবারের যে গোঁড়া মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে একজন প্রগতিশীল উদার মানসিকতায় রূপান্তর করেছেন, তা যেন বিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারের একটি সাধারণ ইতিহাস। বিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান-সমাজের আত্মবিকাশের ধারাটি তাঁর সাংবাদিক-জীবনে স্পষ্ট।
*ড. মো. চেঙ্গীশ খান: অধ্যাপক (বাংলা), বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়