(গণমাধ্যমের উপস্থাপনা, উপস্থাপনার ভাষা, খন্ডিত তথ্য পরিবেশন অথবা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় পক্ষপাতের কারণে সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনমনে নানাসময়ে দেখা দেয় আলোচনা সমালোচনা। পেশাদারিত্বের অভাব আর স্বার্থ কখনও কখনও একাকার হয়ে যায়; দেখা দেয় নানা বিভ্রান্তি। গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব আর সংবাদ পরিবেশনের নানা অসঙ্গতি নিয়ে সাংবাদিক ও লেখক আমীন আল রশীদের পাঠক নন্দিত বই "বাংলাদেশের গণমাধ্যশ : জনআস্থার দোলাচল"। বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে মুক্তবাকে। আজ পড়ুন সপ্তম পর্ব।)
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের বার্তা প্রধান মোস্তফা ফিরোজ ‘হায়রে কি টকশো দেখছি এক টিভিতে!’এরকম একটি স্ট্যাটাস দেন তার ফেসবুক ওয়ালে; যেখানে টকশো নিয়ে নানাজন তীর্যক মন্তব্য করেন। মোস্তফা ফিরোজ নিজেও একজন টকশোর সঞ্চালক এবং বিভিন্ন টিভির টকশোতে আলোচক হিসেবে অংশ নিয়ে থাকেন।
টেলিভিশনে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্য টকশো শীর্ষে। আবার এই টকশো নিয়েই মানুষের সমালোচনাও বেশি। রাত জেগে মানুষ টকশো দেখে। শুধু শহুরে মানুষ নয়, এখন গ্রামের হাটবাজারের চায়ের দোকানে বসেও মানুষ টিভিতে টকশো দেখে। এসব জায়গায় যে পরিমাণ রাজনীতির আলোচনা হয়, সেগুলো ভিডিও করে প্রচার করলেও উপভোগ্য টকশো হতে পারে। কোনো কোনো টেলিভিশন অবশ্য চায়ের দোকানের এই আড্ডা নিয়েই অনুষ্ঠান করছে।
বলা হয়, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে বা রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক আবহ শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে টেলিভিশনের টকশোগুলো বড় ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে যখন রাজপথে, সংসদে বা অন্য কোথাও বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয় তখন টেলিভিশনের টকশোতে এসে দলের নেতারা সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। ফলে অনেক সময় টেলিভশনের এই টকশোকে ‘বিকল্প পার্লামেন্ট’ বলেও অভিহিত করা হয়। আর এ কারণে কোনো কোনো টকশো, টকশোর আলোচক এবং উপস্থাপক ক্ষমতাসীনদের বিরাগভাজনও হয়ে থাকেন।
গণমাধ্যমের ওপর সরকারের চাপ প্রয়োগ, বিশেষ করে সংসদে বিষোদ্গার প্রসঙ্গে ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকদের সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদ’ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম স্বাক্ষরিত প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘টিভি টকশোকে নানাভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কিছু টকশো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। টকশোর অতিথি তালিকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার নিয়ে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। কী প্রচার হবে আর হবে না তা নিয়ে টেলিফোনে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।’
বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক দল হিসেবে ছোট, গুরুত্বহীন এবং জনপ্রিয়তা নেইÑএমন অনেক দলের নেতারাও কেবল এই টকশোর কারণে জনগণের কাছে পরিচিত এবং সেলিব্রিটিতে পরিণত হন। শুধু রাজনীতি নয়, অনেক শিক্ষক, সাংবাদিক, এনজিওকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও ব্যবসায়ীকে মানুষ টিভি ব্যক্তিত্ব হিসেবে চেনে শুধু এই টকশোর কারণে। শোনা যায়, এদের অনেকে মূল পেশায় মাসে যা আয় করেন, তার চেয়ে বেশি আয় করেন টেলিভিশনের টকশোতে এসে। কোনো কোনো আলোচককে মাসের ৩০ দিনই কোনো না কোনো টিভিতে দেখা যায়। কেউ কেউ একদিনে একাধিক টিভিতেও যান। একটি টেলিভিশন শেষ করে আরেকটি টিভিতে যেতে যেতে সেই টিভির অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়, এরকম ঘটনাও মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে। এই আলোচকদের অনেকে রাজনৈতিক-সামাজিক-পারিবারিক নানা বিষয়ে মানুষকে নীতিবাক্য শোনালেও ব্যক্তিজীবনে তারা অসৎ এবং নীতিহীন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
টেলিভিশনের ভেতরে যারা কাজ করেন, বিশেষ করে যারা টকশোর অতিথি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত তারা জানেনÑযিনি কম জানেন, তিনি ভালো বলেন; যিনি বেশি জানেন তিনি কম বলেন এবং টকশোতে কম আসেন বা আসতে পারেন।
প্রথম পর্ব পড়ুন : আগস্ট ট্র্যাজেডি এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম
অনেক সময় ভালো জানাশোনা লোক টকশোতে আসতে আগ্রহবোধ করেন না। অনেকে জানেন ভালো কিন্তু টিভি ক্যামেরার সামনে অস্বস্তিবোধ করেন। কেউ কেউ টকশোর আমন্ত্রণ পেলে জিজ্ঞেস করেন আর কে থাকবেন? অর্থাৎ সহআলোচক পছন্দ না হলে তিনি আসতে আগ্রহবোধ করেন না। এটা অনেকের ইগো সমস্যা।
অনেকে টকশোতে আসার জন্য নানা মাধ্যমে তদবির করেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে ফোন করান। কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট টিভির পরিচিতি কর্মীর কাছে টকশোতে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। কেউ কেউ তাদের অনুজদের দ্বারা তদবির করান। যেমন ঢাকার বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ঢাকায় এলে তার পরিচিত কেউ ফোন দিয়ে বলেন, ‘স্যার তো আজ ঢাকায় আছেন, দেখেন কোনো একটা অনুষ্ঠানে ডাকা যায় কি না।’ আবার শিক্ষকদের মধ্যেই অনেককে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ চাইলেও পায় না। কারণ তারা টকশোতে যেতে চান না। কেউ কেউ রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নিতে ‘ভয়’ পান। কারণ অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিক আলোচনায় নিরপেক্ষ থাকা কঠিন। কারণ সব মন্তব্যই কারো না কারো পক্ষে ও বিপক্ষে যাবে। এতে করে নিরপেক্ষ ব্যক্তিরও কোনো নির্দিষ্ট দলে বিশ্বাসী বলে ট্যাগ লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কোনো কোনো টেলিভিশন সচেতনভাবেই আলোচকদের রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন: সংবাদ সম্মেলন নিজেই যখন সংবাদ
বস্তুত যেসব মুখ প্রতি রাতে টিভির পর্দায় দেখা যায়Ñতাদের সবাই যে নিজের যোগ্যতায় বা টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ খুব সম্মানের সাথে তাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে, এমন নয়। বরং অতিথিদের অনেকে বিশেষ জায়গার অনুরোধ/নির্দেশ/পরামর্শে আসেন বা তাদের আনতে হয়। এ নিয়ে টিভি কর্তৃপক্ষ খুব বেশি বাহাসে যেতে চায় না। কারণ যারা নির্দেশ/পরামর্শ বা অনুরোধ করেন, তাদের কাছে কোনো না কোনোভাবে টেলিভিশনের মালিকপক্ষ কিংবা নীতিনির্ধারকদের দায় আছে।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসির সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টুর (যোগাযোগ, সংখ্যা ১২, জুলাই ২০১৬: পৃষ্ঠা ২৩১) মতে, ‘২৪-২৫টি টেলিভিশনে যদি প্রতিদিন গড়ে ৩০টি টকশো অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে প্রতিদিন অন্তত একশোজন অতিথির দরকার পড়ে। এই বাড়তি চাহিদার কারণে অনেক আলোচক ঘুরেফিরে বিভিন্ন টকশোতে আবির্ভুত হতে দেখা যায়। এই নিয়মিত আলোচকদের বেশির ভাগই সাংবাদিক, পত্রিকার সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আইনজীবী। তাদের অনেকেই আলোচ্য বিষয়ে কোনোরকম হোমওয়ার্ক করে আসেন না। গুরুতর বিষয়ে বাজারচলতি মন্তব্য করে বসেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনুমাননির্ভর তথ্য উপস্থাপন করেন।’
এই নিবন্ধে মি. আহসান আরও লিখেছেন, ‘অধিকাংশ উপস্থাপকই আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না। ফলে তারা কোনো চৌকষ প্রশ্ন করে আলোচনায়ে নতুন মাত্রা যোগ করেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঞ্চালকের প্রশ্ন হয় খুবই বোকা বোকা ধরনের। অনেক সময় সংবাদ পাঠক-পাঠিকাকে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে উপস্থাপনায় বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিক আত্মবিশ্বাসী সঞ্চালক নিজেকে জাহির করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। সঞ্চালকদের জ্ঞানের বহর নিয়ে মাঝে মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।’
তৃতীয় পর্ব পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন
২.
আমাদের দেশে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়া এবং এ কারণে রাজনীতি বিষয়ক আলোচনায় অতিথির কোনো অভাব হয় না। যিনি যে পেশাই থাকুন না কেন তিনি টকশোতে এসে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটির অভাব তা হলো, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনার লোক। এক্ষেত্রে ভরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং এখানেও ঘুরেফিরে কয়েকজন পরিচিত মুখ। একই বিষয়ে কথা বলার মতো শিক্ষক নিশ্চয়ই আরও আছেন। কিন্তু নতুন আলোচকদের আমন্ত্রণ করে টিভি কর্তৃপক্ষ ঝুঁকি নিতে চায় না। কারণ তিনি লাইভে কেমন বলবেন, কী বলবেন, তাতে প্রতিষ্ঠান কোনো বিপদে পড়বে কি না; এসব চিন্তার কারণে কর্তৃপক্ষ ‘পরীক্ষিত’ অর্থাৎ যারা নিয়মিত টকশোতে আসেন, তাদেরকেই আমন্ত্রণ জানায়। ফলে নতুন আলোচকের জায়গা হয় না। অথচ দিনের পর দিন বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে পরিচিতদের চেয়ে অনেক অপরিচিত আলোচকও খুব ভালো কথা বলেনÑমাঝেমধ্যে এরকম উদাহরণও তৈরি হয়। কিন্তু তারপরও অধিকাংশ টেলিভিশন একই মুখ নিয়ে স্বস্তিবোধ করে।
চতুর্থ পর্ব : গণমাধ্যম যেভাবে ‘জঙ্গি’ বানায়
যেমন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা মানেই বুয়েটের এক দুজন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত কয়েকজন শিক্ষক, পরিবেশ-জলবায়ু পরিবর্তন-নদী নিয়ে কথা বলতে হাতেগোনা দুতিনজন। অতিথি নির্বাচনের এই দীনতা দেখে এমন প্রশ্ন ওঠাও অস্বাভাবিক নয় যে, ১৬ কোটি মানুষের দেশে টকশোতে কথা বলার লোকের এতই আকাল?
সমস্যাটা অন্য জায়গায়। তা হলো, যারা টকশোর পরিকল্পনা-সমন্বয় ও উপস্থাপনা করেন, আলোচক নির্বাচনে তাদের নিজেদেরও কিছু এজেন্ডা এবং পছন্দ থাকে। কখনো মালিক বা বিজ্ঞাপনদাতাদের পছন্দ থাকে। কোনো কোনো অতিথির ব্যাপারে টেলিভিশনগুলোয় অলিখিত এমবার্গো (নিষেধাজ্ঞা) থাকে বিশেষ করে যারা সরকারের বেশি সমালোচনা করেন।
পঞ্চম পর্ব : গোপন বৈঠক, গোপন সংবাদের ভিত্তি ও জিহাদী বই
সমসাময়িক নানা বিষয়, বিশেষ করে রাজনীতি ও নির্বাচন ইস্যুতে নিয়মিত টকশোতে যান সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। এক সাক্ষাৎকারে তিনি টেলিভিশনের টকশো নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অভিমত তুলে ধরেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, টেলিভিশনের টকশোগুলো ২০০৬-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই দর্শকরা রাজনৈতিক ও সমসাময়িক নানা ইস্যুতে পক্ষে-বিপক্ষে জানার অবকাশ পেতো। এসব টকশো জনমতকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতো, যার প্রতিফলন পরবর্তী নির্বাচনে দেখা যায়।
মি. মজুমদার মনে করেন, বাংলাদেশের ক্ষমতার সংস্কৃতিতে ময়দানের ভাষায় খিস্তি-খেউড় বা অশালীন আক্রমণ যতটা সহনীয় এবং উপভোগ্য, যৌক্তিক সমালোচনা ততটা নয়। তাই সরকারকে এসব টকশোর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই অসহষ্ণিুতা প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি নির্বাচনের দিন বিকেলে ড. শাহদীন মালিক এবং আমার একটি চ্যানেলে লাইভ টকশোতে অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমাদের অংগ্রহণ এড়াতে পুরো টকশোটিই বাতিল করে দেয়া হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় আরেকটি চ্যানেলের টকশোতে আমার অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার সময় আমাকে একটি এসএমএস দিয়ে জানানো হয় যে, কোনো এক অদৃশ্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমাকে অতিথি তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। শুধু আমিই নই, টকশোর ক্ষেত্রে এ ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপের শিকার আরও অনেকেই হয়েছেন।’
ষষ্ঠ পর্ব পড়ুন : টেলিভিশনের ভাষা
৩.
অনেক সময় দেখা যায়, একই আলোচককে বারবার টকশোতে আমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিভিশনগুলো একটি নিজস্ব বা ‘ঘরোয়া বুদ্ধিজীবী’ শ্রেণি গড়ে তোলেÑযারা তাদের ভাবনাগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিশেষ কারো পারপার্স সার্ভ করার জন্য পরিবেশন করে থাকেন। তাতে জনমত কতটুকু গঠিত হয় বা দর্শকের মানসকাঠামোয় কতুটুক পরিবর্তন আসে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও এর দ্বারা একধরনের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রসারিত হয়। তবে যখন রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ক্রমক্ষয়িষ্ণু তখন অন্তত টেলিভিশনের এই টকশোগুলো কিছু ভিন্নমত বা অলটারনেটিভ থিংকিংয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এর দ্বারা আমাদের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছে তারও কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনার একটা সাধারণ প্রবণতা হলো, দুজন অতিথি থাকলে সেখানে ধরেই নেয়া হয় এদের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগ, একজন বিএনপি। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ যখন অতিথি নির্বাচন করে তারাও সেখানে এই আওয়ামী লীগ-বিএনপিপন্থি বিষয়টি বিবেচনায় রাখে। কিন্তু সব আলোচকই যে এ দুই দলের অনুসারী বা এ দুই দলের পক্ষে-বিপক্ষে বলবেন, এমনটা নাও হতে পারে।
আবার কোনো কোনো উপস্থাপক তাদের অনুষ্ঠানের আলোচকদের ওপর এতটাই নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব বিস্তার করে রাখেন যাতে অনেক সময় দর্শক বিভ্রান্ত হয় যে, আসলে কে আলোচক এবং কে সঞ্চালক? কোনো কোনো উপস্থাপক আলোচনায় কোন বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করবেন তা আগেই ঠিক করে রাখেন। ফলে আলোচকরা যাই বলুন না কেন তিনি গল্পের গরু গাছে তুলতে প্রাণপন সচেষ্ট থাকেন।
মানিকগঞ্জের শিক্ষক ও সাংবাদিক সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু। ফেসবুকে সমসাময়িক নানা বিষয়ে সরব। টকশো নিয়ে একদিন তিনি লিখলেন: ‘কিছু সঞ্চালিকা একজন আমন্ত্রিত অতিথির চেয়েও বেশি বলেন। আমি অনেকদিন স্পওয়াচ হাতে নিয়ে মেপে দেখেছি। কোনো কোনো রাতে এমন আলোচকও টকশোতে আসেন যার তুলনায় সঞ্চালিকার বলা কথার পরিমাণ হয় দ্বিগুণের বেশি। এদের আরেকটি গুণ আছে, এরা প্রথম মিনিট থেকেই একটি পক্ষের আলোচকের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে যান।’
টকশোতে দর্শকের প্রশ্ন নিয়েও প্রশ্ন আছে। যেসব দর্শক লাইভ অনুষ্ঠানে ফোন করেন, তাদের কতজন আসল দর্শক আর কতজন টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব লোক তা নিয়ে দর্শকের মনে সন্দেহ আছে। একসময় প্রকৃত প্রস্তাবেই দর্শকের প্রচুর ফোন নেয়া হত। কিন্তু কিছু কিছু লাইভ অনুষ্ঠানে কিছু দর্শকের অনাকাক্সিক্ষত, বিব্রতকর এবং অপমানজনক প্রশ্নের কারণে এখন লাইভ অনুষ্ঠানে দর্শকের ফোন প্রচারের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ অনেক বেশি সতর্ক থাকে। কেউ ফোন করলে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি কী নিয়ে প্রশ্ন করবেন। কোনো কোনো টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ সরাসরি প্রশ্নটি আগে জানতে চায়। প্রশ্নটি তাদের পছন্দ হলে বা ঝুঁকিপূর্ণ মনে না হলেই কেবল দর্শকের সাথে সঞ্চালকের যোগাযোগ স্থাপন করা হয়।
কোনো কোনো টেলিভিশন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিচালিত হয় এবং তাদের বিরুদ্ধমতের কোনো বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করলে সেখানে ওই বিরুদ্ধমতের কথিত অনুসারী আলোচকদের যে ভাষায় এবং যে ভঙ্গিতে প্রশ্ন করা হয়, তাতে প্রশ্ন ছাপিয়ে সেটি একধরনের ‘জেরা’য় পরিণত হয়। তখন এটি টেলিভিশনের সেট নাকি আদালতের কাঠগড়া, তা ঠিক বোঝা যায় না। আবার এসব অনুষ্ঠান এবং ওই উপস্থাপকগণ বেশ জনপ্রিয়ও বটে। কারণ মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় ঝগড়াঝাটি দেখতে পছন্দ করে। শান্তশিষ্ট ভঙ্গিতে সিরিয়াস বিষয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনার টিআরপি বা দর্শকপ্রিয়তার চেয়ে ঝগড়াঝাটিসম্বলিত টকশোর টিআরপি বেশি।
বই নিয়ে দেখুন চার সাংবাদিকের পাঠ প্রতিক্রিয়া :