স্বাধীনতা এবং ফ্রি স্পিচ-এর পক্ষে দাঁড়ানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার একটা উদাহরণ হচ্ছেন হিকি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তিনি তার লক্ষ্য, ব্যক্তিজীবন এবং পত্রিকা— সবকিছু উৎসর্গ করেছেন। তিনি তার গেজেট-এ বারে বারে আলোচনা করেছেন, যেখানে গণমাধ্যম মুক্ত, সেখানে মানুষও মুক্ত। যেখানে গণমাধ্যম আক্রান্ত, সেখানে মানুষও নির্যাতিত এবং যখন সংবাদ মাধ্যমের আর অস্তিত্ব থাকে না, তখন মানুষের সুরক্ষাও আর থাকে না।
অ্যান্ড্রু ওটিস উপরের কথাগুলো যাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, সেই হিকি হচ্ছেন জেমস অগাস্টাস হিকি। ইউরোপীয় হলেও এ ভদ্রলোক বাঙালির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছেন। আঠারো শতকের শেষভাগে তার প্রতিষ্ঠিত হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট অর দি অরিজিনাল ক্যালকাটা জেনারেলঅ্যাডভারটাইজার ছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকা। এটিই এশিয়া মহাদেশের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে দুই বছর কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পেরেছিল বেঙ্গল গেজেট। তখনকার ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসসহ আরো কয়েকজন শীর্ষ ক্ষমতাধারীর কঠোর সমালোচনা করে শাসকদের রোষের শিকার হন হিকি। তার পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পত্রিকার টাইপ নিয়ে যায় এবং প্রেস জব্দ করে। তাই হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট কেবল এ অঞ্চলের প্রথম ছাপা পত্রিকাই নয়, বরং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সংগ্রামেরও পথিকৃৎ। হেস্টিংসের রোষানলে পড়ে জেমস হিকিকে আদালতে যেতে হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে এবং শেষ জীবন কাটাতে হয়েছে চরম দারিদ্র্যে।
হিকির মৃত্যুর ২০০ বছরের বেশি সময় পর তার জীবনকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন আমেরিকান গবেষক অ্যান্ড্রু ওটিস। জেমস অগাস্টাস হিকি এবং তার বেঙ্গল গেজেট নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর গবেষণা করেছেন ওটিস। সম্প্রতি তার গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন ‘‘দি আনটোল্ড স্টোরি অব ইন্ডিয়া’স ফার্স্ট নিউজপেপার’’ নামক গ্রন্থে। দীর্ঘ এ গবেষণা শেষ করার পর ওটিসের মন্তব্য, ‘চার্চ ও রাষ্ট্রের সমালোচনামূলক সংবাদ প্রকাশ করতে হিকি অসাধারণ সাহস দেখিয়েছিলেন। হিকি সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। কিন্তু পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে হিকির লড়াইয়ের অবসান ঘটে।’ ওটিস মনে করেন, এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হিকি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।’
ওটিসের হিকি অভিযান শুরু হয়েছিল সিনেমা, উপন্যাসের গল্পের মতো। ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারে অধ্যয়নের সময় একটি পেপার লেখার জন্য ওটিস বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির বেজমেন্টে বাদামি রঙের কভারঅলা নামহীন একটি বই দেখতে পান। নিউইয়র্কে সেই লাইব্রেরিরের বেজমেন্টে বসে ঠিক সেক্ষণে ওটিসের মনে হচ্ছিল তিনি দারুণ কিছু খুঁজে পেতে যাচ্ছেন। সত্যই হয়েছিল তার ভাবনা। ধুলো ঝেড়ে পাতা উল্টে দেখলেন বইটা উইলিয়াম হিকের স্মৃতিকথার একটি কপি। এই হিকে ছিলেন আমাদের সাংবাদিক জেমস অগাস্টাস হিকির উকিল। হিকে ছিলেন অষ্টাদশ শতকের এক অভিজাত ইংরেজ; তার ক্লায়েন্ট ছিল ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ডে। ডায়েরিতে তিনি তার ক্লায়েন্টদের বিবরণী নিখুঁতভাবে লিখে রাখতেন। কিছুদিন আগে কলকাতা ঘুরে গিয়েছিলেন ওটিস, তাই কলকাতার অংশটি আগ্রহ নিয়ে পড়লেন। এখানেই পেলেন একটি নাম, যাকে নিয়ে গবেষণা করেই তার পরের কয়েকটি বছর কেটেছে— জেমস অগাস্টাস হিকি। সে বছরের শেষদিকে একটি বৃত্তির কাজ হিসেবে ওটিস লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে বসে ঔপনিবেশিক আমলের ভারতীয় সংবাদপত্রের সংগ্রহ দেখছিলেন। সেই সংগ্রহ দেখতে দেখতে তার সামনে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন হাজির হয়েছিল— ভারতীয় গণমাধ্যমের ইতিহাসের সূচনা বিন্দুটি কোথায়? জবাব মিলল, জেমস হিকির হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট অর দি অরিজিনাল ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভারটাইজার। এটি এশিয়ারই প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র। কিন্তু হিকির জীবন এবং পত্রিকা নিয়ে বাজারে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। অনেকে তো তাকে সাংবাদিক হিসেবেও স্বীকৃতি দেন না। তার কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনাও হয়নি। এখান থেকেই শুরু হয় ওটিসের দি আনটোল্ড স্টোরি অব ইন্ডিয়া’স ফার্স্ট নিউজপেপার।
আমেরিকায় থাকতে এক অধ্যাপকের কাছে ওটিস শুনেছিলেন কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে বাংলার প্রথম সুপ্রিম কোর্ট বিচারক জন হাইডের নোটবুক সংরক্ষিত আছে। কিন্তু ওটিস সেখানে গিয়ে সুবিধা করতে পারলেন না, কারণ সেই নোটবই তখন ডিজিটাইজ করার কাজ চলছে। তাই ওটিস গেলেন ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব ইন্ডিয়ায়। সেখানে হাইডের নোটবুকের একটি ভাঙাচোরা কপি সংরক্ষিত আছে। মাইক্রোফিল্ম দেখতে দেখতে ওটিস এক অদ্ভুত ব্যাপার আবিষ্কার করে বসেন। হাইড বিভিন্ন পাতায় সাংকেতিকভাবে ছোট ছোট নোট লিখে রেখেছেন, কোথাও কোথাও সেগুলো প্রতীকের মতো। হাইড কি কিছু আড়াল করতে চাইছিলেন? নাকি প্রকাশ্যে না বলতে পেরে একটু সংকেত রেখে যেতে চাইছিলেন। ওটিস এই রহস্য ভেদ করতে শরণাপন্ন হলেন নিউ জার্সি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে কর্মরত পুরনো দিনের শর্টহ্যান্ডে বিশেষজ্ঞ ক্যারল জনসনের। কিছুদিন পর ক্যারল হাইডের কিছু সংকেতের মর্মোদ্ধার করে জানালেন হাইড প্রকৃতপক্ষে তার সহকর্মী সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নানা দুর্নীতির কথা নীরবে লিখে রাখছিলেন। হিকির মামলার পূর্ণাঙ্গ বিবরণী দেখতে ওটিস কলকাতা হাইকোর্টের আর্কাইভে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেখানে অনুসন্ধানের অনুমতি মেলা কঠিন কাজ। যাহোক, একসময় অনুমতি পেয়ে গেলেন। এখানে মামলার দলিল খুঁজতে গিয়ে ওটিস হিকির বেঙ্গল গেজেটের একটি কপি খুঁজে পান, যা ২৩০ বছর ধরে গায়েব ছিল। এ সংখ্যাটা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি প্রকাশিত হয়েছিল হিকির বিচারের একদিন আগে। এ সংখ্যায় হিকি পাঠকদের কাছে শাসকদের দমনের মুখে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার লড়াইয়ে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর দিল্লিতে গিয়ে ন্যাশনাল আর্কাইভ অব ইন্ডিয়ায় খুঁজে পেলেন হিকির হাতে লেখা কিছু চিঠি। পাওয়া গেল হিকির স্বাক্ষর। আর ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে দেখলেন হিকির শত্রুপক্ষ ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারক এলিজাহ ইমপে ও কর্নেল টমাস ডিনে পিয়ারসের চিঠি। তাদের চিঠিতে দেখা গেল তারা হিকিকে বেশি ভয় পেতেন। তাদের দৃষ্টিতে হিকি ছিলেন জঘন্য ইতর, আবর্জনার ভাগাড়। ব্রিটিশ জমানায় ইতিহাসবিদরা হিকিকে হেস্টিংসের দৃষ্টিতেই দেখেছেন আবার সাম্প্রতিককালে অনেকে হিকিকে তুলনাহীন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ওটিসের মনে হয়েছে, এই উভয় পক্ষের মন্তব্যই অতি উৎসাহী। আবার হিকিকে নিয়ে অনেক ভুল তথ্যও বাজারে প্রচলিত আছে। যেমন— তাকে ভারত থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। অনেকে তার জন্মস্থানেরও ভুল বর্ণনা দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে হিকির কাজের স্বীকৃতিও জুটছে পণ্ডিত মহলে। তরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, হিকি ছিলেন জীবন বাজি রাখা মোরালিস্ট। স্বদেশীদের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। হিকিকে নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর ওটিসের মনে হয়েছে, তিনি নিজেকে গরিব এবং নিম্নবর্গের মানুষের কণ্ঠ বলে বিবেচনা করতেন। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিরও সমালোচনা করেছেন।
ভারতে প্রথম ছাপাখানা বসিয়েছিল পর্তুগিজ জেসুইট মিশনারিরা, ১৫৫০-এর দশকে। ১৬১৫ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি নিউজলেটার ছেপেছিল। পরবর্তী শতকে দক্ষিণ ভারতে মিশনারিদের হাত ধরে ছাপার কাজের প্রসার ঘটে। অন্যদিকে এশিয়ার ইতিহাসে সংবাদ ছড়িয়ে দেয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি দেখা গেছে বিভিন্ন আমলে। হিকির পত্রিকার এক হাজার বছর আগে চীনে এক ধরনের বুলেটিন বের হতো। মুঘল আমলে ভারতে হাতে লেখা নিউজলেটার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হরকরা বা রানারদের মাধ্যমে বিতরণ করা হতো। ছাপা ও সংবাদ বহনের দীর্ঘ ইতিহাস এশিয়ায় থাকলেও হিকিই প্রথম সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা নিয়মিত প্রকাশিত হতো এবং এর উদ্দেশ্য ছিল তথ্য-সংবাদ ছড়িয়ে দেয়া।
জেমস অগাস্টাস হিকির জীবনের শুরুর দিকের কথা খুব ভালো জানা যায় না। যতটুকু জানা যায়, তার জন্ম ১৭৩০-এর দশকে আয়ারল্যান্ডে। হিকির বাবা ছিলেন তাঁতি এবং অল্প বয়সেই তিনি বাবাকে হারান। তরুণ বয়সে ডাবলিনে এক উকিলের অফিসে কেরানি হিসেবে কাজ পান। কিন্তু এ কেরানির কাজে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই লন্ডনে চলে এলেন এবং এক স্কটিশ ছাপাখানায় শিক্ষানবিশি শুরু করলেন। খুব সম্ভবত তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এ ছাপাখানা শিল্পেই তিনি ক্যারিয়ার গড়বেন। কিন্তু সাগরের ঢেউয়ের মতোই উথাল-পাথাল চলেছে হিকির জীবনে। তাই আপাতত নিজের ছাপাখানা নয় বরং তাকে দেখা গেল ব্রিটিশ নেভিতে, যুদ্ধেও অংশ নিলেন ‘দ্য ক্যাপ্টেন’ নামে। বেশ কয়েক বছর পর আবার ফিরে এলেন লন্ডনে। এবার চাকরি নিলেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত উকিল সার্জেয়ান্ট ডেভির অফিসে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ইংল্যান্ডে দাসপ্রথা নিষিদ্ধকরণের যে রায় হয়েছিল, সেই মামলায় ডেভি লড়েছিলেন। সময়কালের হিসাবে ধারণা করা হয়, এ মামলায় হিকি ডেভির কেরানি হিসেবে সহায়তা করেছিলেন। মামলাটির নাম ছিল সমারসেট বনাম স্টুয়ার্ট এবং এ মামলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৭১-৭২ সালে। সমারসেট নামে এক দাস পালিয়ে যাওয়ার পর তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে জ্যামাইকার এক প্ল্যানটেশনে আবার কাজ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। তখন এর বিরুদ্ধে তার দাদা ইংল্যান্ডের কোর্টে মামলা ঠুকে দেন এবং এ মামলার রায়েই ইংল্যান্ডে দাস প্রথা নিষিদ্ধ হয়।
কিন্তু কিছুদিন পর ডেভির অফিসেও হিকিকে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসল। মামলার বিবরণী পড়ার পাশাপাশি ডেভির পড়ার ঘরে থাকা শল্য চিকিৎসার বইপত্রও ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলেন। এবার তার মনে হলো শল্য চিকিৎসক হলে মন্দ হয় না! কিন্তু লন্ডনে কেউ তাকে সার্জন হিসেবে স্বীকৃতি কিংবা কাজ দিতে চাইল না। তাই আবার ফিরে গেলেন সাগরে, এবার এক জাহাজের শল্য চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে নিয়োগ পেলেন। এ জাহাজ ছিল দাস ব্যবসায়ীর। বেশ কয়েক সফরের পরও তাকে কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হলো না। তাই হিকি জাহাজ থেকে নেমে আরেকবার নিজের ভাগ্যকে যাচাই করতে চাইলেন। এবার তার গন্তব্য ভারত।
১৭৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রকিংহাম নামের একটি জাহাজ হুগলি নদীর মোহনায় নোঙর করে। এ জাহাজের যাত্রী ছিলেন আমাদের আলোচনার মূল চরিত্র জেমস অগাস্টাস হিকি। দুই সপ্তাহ পর হিকি কলকাতা শহরে পৌঁছলেন। কলকাতায় ব্রিটিশদের জাঁক দেখে হিকি হয়তো কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন এখানে হয়তো তার ভাগ্য ফিরবে। ১৭৭৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হিকি জাহাজের সার্জনের সহকারীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতার রাস্তায় নেমে এলেন। এ সময় কলকাতার পরিবেশ ছিল বেশ অরাজক। কোম্পানির কর্মকর্তারা বিপুল ধনসম্পদ কামিয়ে নিচ্ছেন। বিলাসী প্রাসাদ তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে রাস্তাঘাটে নানা ধরনের অপরাধীদের আড্ডাখানা। প্রশাসনিক, নগর শৃঙ্খলার বালাই নেই।
কলকাতায় হিকি তার যাত্রা শুরু করলেন শল্য চিকিৎসক হিসেবে। রোগে নানা ধরনের ওষুধ দিতেন, রক্তপাত বন্ধ করতেন। কিছুদিন পর ধারদেনা করে ছোট একটা জাহাজ কিনে কলকাতা-মাদ্রাজ মালপত্র পরিবহনের ব্যবসা শুরু করলেন। ১৭৭৬ সাল নাগাদ তার জাহাজের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেল। এর মধ্যে পাওনাদাররাও ধৈর্য হারাচ্ছেন। বিপদেই পড়লেন হিকি। নিজের শেষ সম্বল ২ হাজার রুপি এক বিশ্বস্তজনের কাছে গচ্ছিত রাখলেন, যেন ব্যাংক সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে নিতে না পারে। ১৭৭৬ সালের ২০ অক্টোবর জীবনে প্রথমবারের মতো কারাগারে যেতে হলো, দেউলিয়া হিসেবে। ব্যাংক তার জাহাজ, বাড়ি, আসবাব— সবকিছু বাজেয়াপ্ত করে নিল। কিন্তু এই অবস্থাতেও হিকি দমে যাওয়ার মানুষ নন। তরুণ বয়সে অর্জন করা দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। জেলে তখন বন্দিদের খাবারের খরচ নিজেদেরকেই জোগাতে হতো, তাই কারাগারে থেকেই অনেকে অনেক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতেন। হিকি তার বিশ্বস্তজনের কাছ থেকে ২ হাজার রুপি সংগ্রহ করলেন। এ অর্থ দিয়ে টাইপ কেনালেন এবং একজন ছুতার মিস্ত্রিকে ভাড়া করলেন একটা প্রিন্টিং প্রেস তৈরি করার জন্য। এসব কিছু গোপনে কারাগারের ভেতরে হিকির কাছে পাচার করা হলো। কারাগারে নিজের কুটিরে বসে হিকি তার প্রেস নিয়ে কাজ করতেন। সকাল ৬টায় কাজ শুরু করতেন, শেষ করতে করতে কখনো কখনো রাত একটা-দুটো বেজে যেত। তার কাজের মধ্যে ছিল হ্যান্ডবিল, বিজ্ঞাপন, পঞ্জিকা, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের দলিল, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ফর্ম। হাতে কপি করার অতিরিক্ত খরচ ও সময় বাঁচাতে কিংবা অল্প পরিমাণ ছাপার জন্য সবাই হিকির শরণাপন্ন হতে শুরু করলেন। বেশ কয়েক মাসের কঠোর পরিশ্রমের পর হিকি কিছু অর্থ জমা করতে পারলেন, যা ইংল্যান্ড থেকে ছাপা যন্ত্র আনানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। যাহোক অনেক ঝামেলার পর মামলার রায়ে হিকি ঋণ থেকে মুক্ত হলেন এবং ১৭৭৮ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন।
কারাগার থেকে বের হওয়ার পর হিকির ছাপার ব্যবসা বেশ জমে উঠল। ১৭৭৯ সালের আগস্টে হিকি কোম্পানির সেনাবাহিনীর রেগুলেশন ছাপার দায়িত্ব পেলেন। কোম্পানির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় এ ছাপার কাজ হিকিকে দিয়েছিলেন সেনা কমান্ডার ইন চিফ স্যার আয়ার কুটে। কিন্তু কাজ শুরু করেই বিপদে পড়ে যান হিকি। কলকাতা ছেড়ে যান কুটে, অন্যদিকে কাজের অর্ডারের বিস্তারিত সংরক্ষিত ছিল না এবং কুটে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে না জানিয়েই হিকিকে এ অর্ডার দিয়েছিলেন। অন্যদিকে তখন হেস্টিংসের বন্ধু চার্লস উইলকিনস ও নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড (বাংলা ভাষার ব্যাকরণের প্রথম গ্রন্থের লেখক) কলকাতার কাছেই একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছেন এবং হেস্টিংস কোম্পানির সব বিভাগকে তার বন্ধুদের ছাপাখানা থেকে সব ছাপার কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবার সেনাবাহিনীর অনেক বড় কর্মকর্তা নতুন রেগুলেশন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। অথচ এ ছাপা কাজের জন্য হিকি ততক্ষণে ৪ হাজার রুপি ধার করেছেন। কাজ ও কিছু যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য লোক ভাড়া করেছেন। মূল ছাপা শুরুর আগে প্রুফ শিট পাঠালে কোম্পানির কর্মকর্তারা দেখে দিতে গড়িমসি করতেন। সপ্তাহ লাগিয়ে দিতেন, ফলে হিকিকে কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হতো। যাহোক, কর্মকর্তাদের নানা ধরনের অসহযোগিতার কারণে ২১ হাজার ৭৩৪ পাতা ছাপার পর হিকি কাজ বন্ধ করে কুটের কলকাতা ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলেন। আর ছাপা রেগুলেশন কুটের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। এসব ঝামেলা আরো বেড়ে গেলে হিকির মনে হলো এ পেশাদার ছাপাখানার চেয়ে জীবনে তার আরো কিছু করার আছে, যার মাধ্যমে তিনি সমাজের জন্য কিছু করতে পারবেন।
১৭৮০ সালের জানুয়ারি মাস, কলকাতায় বেশ শীত। শহরে এক পোস্টার বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জেমস হিকি সেঁটেছেন এসব পোস্টার আর তাতে লেখা হয়েছে তিনি একটি পত্রিকা চালু করতে যাচ্ছেন, যা শুধু ভারতে নয় এ এশিয়া মহাদেশেই প্রথম। তার প্রতিজ্ঞা তিনি ভারতে নিউজ রিপোর্টিংয়ে বিপ্লব তৈরি করবেন। তার পত্রিকা থেকে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য পাবেন। সংবাদপত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য হিকির হরকরাদের দরকার হলো। সময়টা সংবাদপত্র চালুর জন্য একেবারে উপযুক্ত ছিল। ব্রিটিশরা তখন তিনটি মহাদেশে চারটি যুদ্ধ করছিল— আমেরিকান, ফরাসি, স্প্যানিশ ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধগুলো বাণিজ্যকে ব্যাহত করছিল এবং পণ্য পরিবহনকে বিপদগ্রস্ত করে তুলেছিল। পণ্য পরিবহনের রুট এবং নিরাপদ যাত্রাপথের খোঁজ পেতে তখন পত্রিকার প্রয়োজনীয়তা অনেক। ভারতের প্রথম সাংবাদিক হিসেবে সংবাদ এবং পাঠকের ওপর হিকির ছিল একচেটিয়া রাজত্ব। এছাড়া তখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীও ছিল তার সংবাদের অন্যতম ভোক্তা। সংবাদপত্রের মাধ্যমে তারা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের খবর পেত।
সংবাদপত্র প্রকাশের বিপদ সম্পর্কে হিকি ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। ইংল্যান্ডে ছাপাখানায় কাজ করার সময়ই সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের কারাগারে যেতে দেখেছেন। এ রকম একজন ইংরেজ সাংবাদিক ছিলেন বিখ্যাত জুনিয়াস লেটারস-এর প্রকাশক হেনরি স্যাম্পসন উডফল। রাজার বিরুদ্ধে মানহানিকর সংবাদ প্রকাশ করায় তার বিরুদ্ধে সরকার মামলা করে এবং কারাগারে পাঠায়। আরেকজন ছিলেন জন উইলকস। অশ্লীল কবিতা প্রকাশ এবং সাত বছর যুদ্ধের পর ফ্রান্সের সঙ্গে রাজার শান্তি চুক্তির সমালোচনা করায় তাকে দণ্ডিত করা হয় এবং ২২ মাস কারাভোগ করেন। তার সমর্থকদের ওপর গুলিও চালানো হয় এবং অনেকে মারা যান। এ ঘটনা ম্যাসাকার অব সেন্ট জর্জে’স ফিল্ডস নামে খ্যাত। জন উইলকস শেষমেশ ফ্রান্সে চলে যান। হিকি প্রতিজ্ঞা করেন তার সংবাদপত্র হবে ‘সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের অনুগত’।
১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি কলকাতার রাধা বাজার থেকে জেমস হিকি প্রকাশ করেন হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট, যা এশিয়ার প্রথম সংবাদপত্র। জেমস হিকি তার পত্রিকার মূল নীতি ঠিক করেছিলেন এ রকম—
Open to all Parties, but influenced by None — হিকি’জ বেঙ্গল গেজেটের মাস্ট হেডের নিচেই ছাপা থাকত এ বাক্য।
পত্রিকাটি প্রকাশের পরই হইচই ফেলে দিল। জেমস হিকির উকিল উইলিয়াম হিকের কথায়, নতুন একটি বিষয় হওয়ায় সবাই এটা পড়ত এবং উচ্ছ্বসিত ছিল। আত্মীয়স্বজনকে এখন আর চিঠি লিখে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিবরণ দিতে হয় না, তার চেয়ে বেঙ্গল গেজেটের কপি পাঠিয়ে দিলেই হয়। যেমন— এ সময় এলিজা ফে ইংল্যান্ডে থাকা তার বোনকে চিঠি লিখছেন, ‘তোমাকে নিয়মিত কলকাতা গেজেট (হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট) পাঠাতে পারলে আমার আর চিঠিগুলোয় রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ লিখতে হবে না।’ হিকি যে সময়ের স্রোতকে ধরতে পেরেছিলেন, তা বোঝা যায় ১৭৮০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অ্যান্ড্রু রসের কাছে ফিলিপ ফ্রান্সিসের লেখা চিঠিতে—
‘কলকাতার জনসংখ্যা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এখানে একটা সংবাদপত্র চালু হয়ে গেছে। আমি আপনাকে পত্রিকার একটা কপি পাঠাচ্ছি। আমার মনে হয় দ্রুততম সময়ে এটা মর্নিং পোস্টের মতো স্ক্যান্ডালে ভর্তি হয়ে যাবে।’
হিকি তার পত্রিকায় সাধারণ মানুষের কথা তুলে আনতে চাইতেন। তার উদ্দেশ্য ছিল পত্রিকাকে সমাজের বিকাশে কাজে লাগানো। নিজের প্রতিজ্ঞামতো তিনি রাজনৈতিক বিষয় ছাপতেন না, বিশেষত কোনো রাজনৈতিক পক্ষের বক্তব্য একেবারেই প্রকাশ করতেন না। তিনি কলকাতা শহরের অবকাঠামো এবং ব্যবস্থাপনার নানা সমস্যার কথা প্রকাশ করতেন। তার এক প্রতিবেদক ছিলেন পর্তুগিজ সেমিট্রির কাছে, সেই প্রতিবেদক সংবাদ লিখলেন যে কবরস্থান পানিতে ভেসে গিয়ে অনেক লাশ খাবার পানির উেস মিশে যাচ্ছে, যা অবশ্যই বন্ধ করা দরকার। কিছুদিন পর বোঝা গেল হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট অনেকেই পড়ছেন— কোম্পানির কর্মকর্তা থেকে সাধারণ মানুষ। পত্রিকায় তুলে ধরা শহরের অনেক সমস্যারও সমাধান হয়। ধীরে ধীরে পত্রিকার প্রভাব বৃদ্ধি এবং ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হিকিকে রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহী করে তুলল।
হিকি ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্নীতির বিরুদ্ধে পত্রিকায় লিখতে শুরু করলেন। তবে এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। যেমন— তিনি কলকাতা থেকে দূরে অবস্থিত রাজ্যগুলোর দুর্নীতির ঘটনা লিখতেন। মাদ্রাজের গভর্নর স্যার টমাস রামবোল্ডকে নানা অভিযোগে ব্রিটেনে ডেকে পাঠানো হয় এবং তিনি পার্লামেন্টে জেরার মুখে পড়েন। হিকি এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যঙ্গ করে তার পত্রিকায় লিখলেন, ‘রামবোল্ড একজন মহান মানুষ, যিনি ভারতে বসে ৬ লাখ পাউন্ড কামিয়েছেন; যার বেশির ভাগই এসেছে ঘুষ আর জুলুমের মাধ্যমে।’
১৭৮০ সালের ১৮ নভেম্বর বার্নার্ড মেসিংক এবং পিটার রিড কলকাতায় প্রকাশ করেন ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ নামের একটি পত্রিকা। এর মাধ্যমে হিকি পেলেন একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বীকে। এ দুই পত্রিকার মধ্যে পার্থক্য ছিল স্পষ্ট। হিকি বলতেন গরিবদের কথা আর মেসিংক বলতেন ধনীদের কথা। হিকি স্বাধীন আর মেসিংক ওয়ারেন হেস্টিংসের মদদপুষ্ট। ধীরে ধীরে ইংরেজ কর্মকর্তারা হিকির লেখালেখি নিয়ে বিরক্ত হতে শুরু করেন। তারা মনে করতেন হিকি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে শহরে বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছেন। এমন সময় হিকি তার কলকাতা জীবনের শুরুর দিকে তার ব্যবসার জন্য বোর্ড অব ট্রেডের প্রধান সিমিওন ড্রোজের অবৈধ সুবিধা নেয়ার চেষ্টার কথা প্রকাশ করেন। এবং এটাও জানান যে কিছু কাগজের সমস্যা সমাধানে ড্রোজ তাকে মিসেস হেস্টিংসের কাছেও নিয়ে গিয়েছিলেন। ড্রোজ তখন বিষয়টির প্রতি ওয়ারেন হেস্টিংসের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। হেস্টিংস বুঝতে পারেন হিকিকে আর ছাড় দেয়া যাবে না। তিনি ডাকযোগে হিকির পত্রিকা বিলির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। হিকি টললেন না। তার মনে হলো এটা ব্রিটিশ আইনেই অবৈধ। পরের সংখ্যায় তিনি নাম উল্লেখ না করেই ড্রোজ আর হেস্টিংসের সমালোচনা করলেন। পত্রিকা বিতরণের জন্য হরকরা ভাড়া করলেন। পত্রিকার জনপ্রিয়তা তখনো অক্ষুণ্ন। পাঠকরা চিঠি লিখে হিকিকে সমর্থন জানাতে শুরু করলেন। একজন হিকিকে ‘পাপা অব বেঙ্গল প্রেস’ নামে সম্বোধিত করলেন। হিকি তার পাঠকদের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখলেন, যা সংবাদপত্রের ইতিহাসে অনন্য দলিল হয়ে থাকবে:
He (James Hicky) has now but three things to loose : his honour in the support of his paper, his liberty and his Life....
And let them see that he is a Freeman of the first City in the British Empire... and that he has a power to print a Newspaper that no East India Company nor the King their Master can wrest out of his hands. It is beyond the preorhative of the British Crown to invest the Company or their servants with such a power.
হেস্টিংস বুঝলেন ভারতে কোম্পানি একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন জারি করেছে, আর হেস্টিংস হচ্ছেন সব ক্ষমতার উৎস। এবার তিনি কোম্পানির দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে জোরেশোরে লিখতে শুরু করলেন। হিকি তার সংবাদ প্রতিনিধিদের দুর্নীতির খবর জোগাড় করতে উৎসাহ দিতে শুরু করেন। পত্রিকার প্রতি সংখ্যাতেই হেস্টিংসের সমালোচনা ছাপা হতে শুরু করে। বিভিন্ন কাজের চুক্তিতে হেস্টিংস যে তার পছন্দের লোকদের প্রাধান্য দিতেন, সেটা প্রকাশ করা হয়। ১৭৭৮ সালে হেস্টিংস বর্ধমান জেলার বাঁধ নির্মাণ (পুলবন্দি) সংক্রান্ত কাজ দেন তার পছন্দের লোক ফ্রেজারকে। যে কাজে আগে বছরে বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার টাকা, সেখানে ফ্রেজারকে দেয়া হলো ৯০ হাজার টাকা। হিকি এ ঘটনার কড়া সমালোচনা করেন এবং ব্যঙ্গ করে ফ্রেজারের নাম দেন ‘লর্ড পুলবন্দি’। শিগগিরই জেমস হিকিকে আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হলো এবং তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারক ইমপে রায় দেন। ১৭৮১ সালের জুনে হিকি কারাগারে গেলেন। তবে জেলে বসেও হিকি তার পত্রিকার প্রকাশ চালিয়ে গেলেন। হেস্টিংসের সমালোচনাও বন্ধ হলো না। হেস্টিংস বেশ কয়েকবার হিকির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করলেন। কয়েকটি খারিজও হয়ে গেল। শেষমেশ ১৭৮২ সালের মার্চে হিকির প্রেস জব্দ করা হয়। এমনকি হিকির বাড়ি ও অফিসের মালপত্র, কাপড়চোপড়, চিঠিও পুলিশ জব্দ করে। দুই সপ্তাহ পর হিকির সব মালপত্র নিলামে তোলা হয়। কোম্পানির ছাপাখানা কর্তৃপক্ষই হিকির যন্ত্রপাতি বাজারমূল্যের ষোলো ভাগের এক ভাগ দাম দিয়ে কিনে নেয়। বন্ধ হয়ে গেল হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট।
জেমস অগাস্টাস হিকি ইউরোপীয় হলেও দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিকতার ইতিহাস তাকে দিয়েই শুরু হয়েছিল। এবং তার কিংবদন্তি কখনো অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার নয়। তার প্রিন্টিং প্রেস চলেছিল পাঁচ বছর আর পত্রিকাটা দুই বছর। কলকাতার পরবর্তী ছাপা সাহিত্যের ইতিহাস হিকির কাছে বিপুলভাবে ঋণী। হিকির অধীনে অনেকে ছাপাখানার কাজ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। ১৭৯২ সালে হিকির দুই সহকারী পল ফেরিস ও আর্কিবাড টমসন কলকাতা মর্নিং পোস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। ফেরিস পরবর্তীতে কলকাতায় বই বিক্রির ব্যবসায় যুক্ত হন এবং গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্যের লেখা ‘আনন্দ মঙ্গল’ নামে প্রথম অলঙ্করণ করা বাংলা বই প্রকাশ করেন। এ গঙ্গা কিশোর দ্বিতীয় বাংলা সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর প্রকাশক ছিলেন। ধারণা করা হয় হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট-এর প্রতি সম্মান জানিয়েই তিনি এ রকম নামকরণ করেছিলেন।
এ লেখা তৈরি করতে গিয়ে কথা হয় অ্যান্ড্রু ওটিসের সঙ্গে, প্রশ্ন করি জেমস অগাস্টাস হিকির ইতিহাস আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক কিনা? ওটিস হ্যাঁসূচক উত্তর দিয়ে বলেন, ‘আজকের দিনে সাংবাদিকরা যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন, তা প্রেসের স্বাধীনতার জন্য হিকির করা লড়াইয়ের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন নয়। দুনিয়াজুড়ে সাংবাদিকরা কর্তৃত্ববাদী সরকারের হুমকিতে পড়ছেন। দারুণ চাপের মধ্যে সাংবাদিকদের অনেক সময় সেলফ-সেন্সর করতে হচ্ছে। কিন্তু আমি সাংবাদিকদের যেকোনো মূল্যে সত্য প্রকাশে উৎসাহিত করি। হিকি কখনো সেলফ-সেন্সর করেননি। তাকে কয়েক বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে, কিন্তু তার লেখা দুর্নীতি এবং স্বৈরশাসনকে বেপর্দা করে দিয়েছে। ইতিহাস তাকে স্মরণ করে।’
দুই বছর তিন মাস জেল খেটে ১৭৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে জেমস অগাস্টাস হিকি মুক্ত হন। এর কিছুদিন পরে শনির দশা শুরু হয় ওয়ারেন হেস্টিংসের। ১৭৮৪ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি লন্ডন ফিরে যান। হাউজ অব কমন্স তাকে বিভিন্ন অভিযোগ ইমপিচ করে। জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর হিকি আবার তার পত্রিকা চালুর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। ততদিনে শরীর ভেঙে পড়েছে। কোম্পানির সঙ্গে লড়াই করে তিনি ঋণের ভারে জর্জরিত। পাওনাদারদের ভয়ে লুকিয়ে থাকতেন। পরিস্থিতি একসময় এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে নিজের প্রতিপক্ষ ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে তিনি সাহায্য চান। ১৭৯৩ সালের ১৩ নভেম্বর হিকি ওয়ারেন হেস্টিংসকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যা থেকে তার অসহায় অবস্থার চিত্রটি স্পষ্ট হয়—
এখন আমি বুড়ো হয়ে গেছি। আমি কি এখানে মরতে পারি... আমার সন্তানদের এখন কলকাতার রাস্তায় ভিক্ষা করার দশা।
১৭৯৭ সালের ১২ এপ্রিল মৃত্যুর আগে জেমস হিকির জীবনের শেষ প্রকাশ্য উপস্থিতির কথা জানা যায়। সেদিন তার গাড়োয়ানের স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে এক মাতাল। হিকি তখন সেই মাতাল খোয়াজিকে দ্রুত তার বাড়ির উঠান থেকে চলে যেতে নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই মাতাল না যাওয়ায় হিকি তাকে ধাক্কা দেন। তখন উপস্থিত হয় খোয়াজির পিতা ফাইজুল্লাহ। হিকির সঙ্গে তারও তর্কাতর্কি হয়, এক পর্যায়ে ফাইজুল্লাহ কিছু স্থানীয় মানুষ জড়ো করে হিকির বাড়িতে হামলা করে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে হামলাকারীদের হটিয়ে দেয়। এ ঘটনাটি লন্ডনের পত্রপত্রিকায় সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। এ ঘটনায় মামলা হয় এবং তদন্তে হামলাকারীদের নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। লন্ডনের পত্রিকায় লেখা হয় যে, মামলাটি কলকাতায় বেশ আলোড়ন তুলেছিল। পত্রিকায় লেখা হয়, কলকাতাবাসী বেশ আগ্রহ নিয়ে আদালতে বসে থাকে এক বিখ্যাত ব্রিটিশ বুড়ো মানুষকে দেখার জন্য, যিনি কলকাতা বা ভারতের প্রথম ছাপা সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন।
পরের দুই বছরে হিকির আর কোনো দালিলিক অস্তিত্ব নেই। হিকির কাগজে লেখা শেষ যেই শব্দগুলো পাওয়া যায়, তা ১৭৯৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর ওয়ারেন হেস্টিংসকে লেখা একটি চিঠি। হেস্টিংসের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে হিকি চিঠিতে লিখেছিলেন—
....আমার এবং আমার সন্তানদের দুর্দশার বিবরণ পড়তে আপনারও কষ্ট হবে।...
এরপর আমরা হিকিকে খুঁজে পাই তার শেষ যাত্রায়, মানে অ্যাজাক্স নামের এক জাহাজে। ১৮০২ সালের মে মাসে হিকি চীনগামী জাহাজ অ্যাজাক্সে চেপে বসেন। গন্তব্য ছিল চীনের ক্যান্টন। ধারণা করা হয়, সেখান থেকে ভারতে মসলা আমদানি করে, এমন একটি দলের সঙ্গে কাজ করতে যাচ্ছিলেন হিকি। হয়তো বৃদ্ধ বয়সে জীবিকা নির্বাহে শেষ এবং বেপরোয়া চেষ্টা। চীনে পৌঁছানোর আগেই অ্যাজাক্সে তার মৃত্যু হয় এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে হিকির লাশ সাগরে ফেলে দেয়া হয়। সলিল সমাধি হলো জেমস অগাস্টাস হিকির। জাহাজে করেই একদিন বাংলায় এসে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন তিনি আর জাহাজে শুয়েই ছাড়ালেন দুনিয়ার মায়া।
জেমস অগাস্টাস হিকির জীবনের অনেক অজানা তথ্য তুলে এনে যিনি তাকে নতুন করে হাজির করলেন, সেই গবেষক ওটিস বর্তমান লেখককে জানালেন, ‘কোনো গণতন্ত্রই মুক্ত গণমাধ্যম ছাড়া টিকতে পারে না। কারণ গণমাধ্যম সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ রাখে। সাংবাদিকরা সত্যিকার অর্থে পাবলিক সার্ভেন্ট। তারা কথা বলতে না পারা মানুষের মুখে আওয়াজ জোগান।’ নিজের দেশের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তার অস্তিত্বের জন্য মুক্ত গণমাধ্যমের কাছে ঋণী।’
লেখার শেষে অ্যান্ড্রু ওটিসের বইয়ের সূত্রে একটি তথ্য সবাইকে জানিয়ে রাখা যায়, আজকের দিনে দুনিয়ায় হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট-এর চারটি পূর্ণাঙ্গ কপি এখনো টিকে আছে।
(বিজনেস ডেইলি বণিকবার্তার শুক্রবারের সাময়িকি সিল্করুটে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত - মুক্তবাক)