মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাতে। কিন্তু ওই ঘটনার সংবাদ আরও একবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমাদের গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন মাধ্যম কী ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের খবরটি নিয়ে শুধু টেলিভিশন নয়, সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এবং জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম হিসেবে পরিচিত প্রথম আলো এবং অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজও এই প্রতিযোগিতায় শামিল হয় এবং তারাও অপেশাদারিত্বের পরিচয় দেয়।
বিষয়টি নিয়ে ঘটনার রাতেই ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনা হয়। আশার কথা, এই সমালোচকদের একটা বড় অংশই গণমাধ্যমকর্মী। তাই এই আত্মসমালোচনা ভবিষ্যতে গণমাধ্যমের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয় ১১ এপ্রিল (শনিবার) রাত সাড়ে ১০টায়। কিন্তু ১০টার কিছু পরেই যমুনা টেলিভিশন ব্রেকিং নিউজ দেয় যে, ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেছে। তারা এটি শুধু স্ক্রল বা টিকারে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা টিভি স্ক্রিনের পুরোটাজুড়েই এই ব্রেকিং চালায়।
ঘটনার সময় চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নিউজরুমে ডিএনই (ডিউটি নিউজ এডিটর) ছিলাম আমি এবং তখন আরও কয়েকজন সিনিয়র সহকর্মীও নিউজরুমে ছিলেন। ফলে যমুনার ওই ব্রেকিং নিউজ দেখে আমরা বিভ্রান্ত হই। কারণ আমাদের কাছে তথ্য ছিলো, ফাঁসি কার্যকর হবে রাত ১০টা ৩১ মিনিটে। ফলে আমরা কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে থাকা আমাদের তিনজন সহকর্মীর (আরিফুল সাজ্জাত, সাজিদ হক, রাশেদ নিজাম) সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু তারা কেউই বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারছিলেন না। তবে সহকর্মী রাশেদ নিজাম বেশ জোর দিয়েই বলছিলেন, ফাঁসি এখনও হয়নি। সাড়ে ১০টায় হবে। তার সাথে আমাদের এই কথা যখন চলছিল, তখন দেখা গেলো সময় টেলিভিশনসহ আরও একাধিক টেলিভিশন ব্রেকিং দেয়। তখনও আমার ব্রেকিং দিইনি। বরং সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম এবং আমাদের রিপোর্টারের ওপর আস্থা রাখছিলাম। কিন্তু আমাদের সেই আস্থায় চিড় ধরায় খোদ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন বিটিভি এবং দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাসযোগ্য চ্যানেল হিসেবে পরিচিতি এনটিভি। আমরা যখন দেখলাম বিটিভি এবং এনটিভিও ব্রেকিং দিয়েছে যে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, তখন আমাদের রিপোর্টারের কথা না শুনে স্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে আমরাও ব্রেকিং দেই। তখনও আমাদের সন্দেহ যাচ্ছিল না। তখন আমাদের সহকর্মী জুনায়েদ খান নিউজরুমে বসেই ফোন করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে। আমরা লাউড স্পিকারে শুনতে পাই আইনমন্ত্রী বলছেন, ‘আমার জানামতে এখনও ফাঁসি কার্যকর হয়নি।’ তখন আমাদের ঘড়িতে ১০টা ২৫ মিনিট।
সাড়ে ১০টায় আমাদের রিপোর্টাররা নিশ্চিত করেন যে, ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, তখন আবার ব্রেকিং চালু করি। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে বোধ হয় আমাদের কোনো কার্পণ্য করা উচিত নয় যে, স্রোতে গা ভাসিয়ে ফাঁসি কার্যকরের আগেই এই ব্রেকিং সংবাদ দেয়াটা মোটেই পেশাদারিত্বের পরিচয় বহন করেনি।
তবে স্রোতে যে কেবল সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশনই গা ভাসিয়েছে তাই নয়; বরং দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম হিসেবে পরিচিত প্রথম আলোও ফাঁসি কার্যকরের আগেই এই সংবাদ প্রকাশ করে। সাড়ে ১০টা বাজার আগেই তারা যে সংবাদ আপ করে, সেখানে বলা হয়, শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
এক্ষেত্রে আরেক নির্ভরযোগ্য অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ছিল আরও এক ধাপ এগিয়ে। তারা রাত ১০টা ১০ মিনিটে মোবাইল ফোনে যে ব্রেকিং নিউজ পাঠায়, সেখানে বলা হয় যে কামারুজামানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তার মানে তাদের খবর অনুযায়ী রাত ১০টা ১০ মিনিটের আগেই ফাঁসি হয়েছে।
অবশেষে আমরা জানতে পারলাম, ফাঁসি কার্যকর হয়েছে আসলে রাত সাড়ে ১০টায়। খোদ সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী জেলগেটে এসে সাংবাদিকদের এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
তাহলে রাত ১০টার কিছু পর থেকেই ব্রেকিং নিউজের নামে আমরা যা প্রচার ও প্রকাশ করলাম, তার দায়ভার কে নেবে? যদি এটি অপরাধ হয়, তাহলে সেই অপরাধে কার কার বিচার হবে? রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন বিটিভিও যখন ভুল সংবাদ ব্রেকিং হিসেবে চালিয়েছে এবং তাদের ব্রেকিং দেখার পরেই যেহেতু আমরাও ব্রেকিং দিয়েছি, সেখানে আমরা কি আমাদের ভুলের জন্য বিটিভিকে দায়ী করতে পারি? এসব প্রশ্নের এক কথায় জবাব নেই।
কিন্তু যে জবাবটি আছে তা হলো, ব্রেকিং নিউজের নামে আমাদের গণমাধ্যম যা প্রচার ও প্রকাশ করে, তা অনেক সময়ইসাধারণ মানুষের কাছে গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয় বা ব্রেক করে।
২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাতের ওই ব্রেকিংযুদ্ধ দেখে একাধিক দর্শক আমাদের ফোন করেছেন। তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, এই অসুস্থ ব্রেকিংযুদ্ধ কতটা জরুরি? অনেকে হয়তো বলবেন, যে টেলিভিশন সবার আগে খবরটি দিলো, এটি তাদের টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) বা দর্শকপ্রিয়তা বাড়ায়। কিন্তু যখন ব্রেকিংটি ভুল প্রমাণিত হলো, তখন দর্শকদের যে প্রতিক্রিয়া হয়, তা কি আমরা কখনো দেখাতে পারি?
তার চেয়ে বড় কথা, কোন টেলিভিশন কোন খবরটি কার কত সেকেন্ড আগে ব্রেকিং দিলো, সেটি কেবল টেলিভিশনের নিউজরুমে যারা থাকেন, তারাই জানেন। এ নিয়ে আত্মতৃপ্তি বা অসন্তুষ্টি/অস্বস্তি একান্তই সংবাদকর্মীদেও; দর্শকের নয়। কেননা, নিউজরুমে সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেল একসঙ্গে চালু থাকে। কিন্তু একজন দর্শকের বাসায় বা অফিসে সাধারণত একটির বেশি টেলিভিশন সেট থাকে না। সেক্ষেত্রে কোন টেলিভিশন অন্য কোন চ্যানেলের কত সেকেন্ড আগে ব্রেকিং দিলো, তা দর্শকদের জানার কথা নয়। বরং প্রত্যেকেরই একটা নিজস্ব পছন্দ আছে। কে কোন টিভি দেখবেন, সেটি তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। সে হিসেবে অন্য চ্যানেলের ৫ সেকেন্ড বা ১০ সেকেন্ড আগে ব্রেকিং নিউজ দিলেও, পরক্ষণেই তা আর ব্রেকিং থাকে না। কারণ অন্যরাও তখন তা প্রচার করে।
প্রশ্ন হলো, কামারুজ্জামানের ফাঁসি নিয়ে গণমাধ্যমকে কেন এই অসুস্থ ব্রেকিংযুদ্ধে নামতে হলো? এর জন্য বিষয়টি নিয়ে সরকারের হাইড এন্ড সিক বা লুকোচুরি খেলাকে দায়ী করা যায়। কেননা, কামারুজ্জামানের ফাঁসির বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয় ৮ এপ্রিল থেকেই; যেদিন কামারুজ্জামানকে তার রিভিউ খারিজের আদেশ বাতিল সম্পর্কিত আপিল বিভাগের রায় পড়ে শোনানো হয়। আদেশ শোনার পরে কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না এবং কখন তার রায় কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে একের পর এক মঞ্চায়ন হতে থাকে নাটক। বিশেষ করে ১০ এপ্রিল (শুক্রবার) বিকেলে থেকেই তার ফাঁসির যে প্রস্তুতি শুরু হয়, তাতে মোটামুটি এটা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিলো যে, ওই রাতেই কামারুজ্জামানের দ- কার্যকর হচ্ছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জানা গেলো, ফাঁসি হচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশে শুক্রবার রাতে ফাঁসি কার্যকরের রেওয়াজ নেই।
সবারই এটা মনে থাকার কথা যে, ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে গণমাধ্যমে কী ধরনের বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশ ও প্রচার হয়েছিলো। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বিডিআর বিদ্রোহের খবরের এই বিভ্রান্তির মূলে ছিলো এ বিষয়ে সরকারি কোনো বক্তব্য না পাওয়া। আমরা বহুবার চেষ্টা করেও সরকারের ঊর্ধ্বতন কারো বক্তব্য পাইনি। এ নিয়ে সরকারের কোনো মুখপাত্র যদি নিয়মিত ব্রিফ করতেন, তাহলে বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হতো না।
একইভাবে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি নিয়েও যদি সরকারের তরফে নিয়মিত সাংবাদিকদের অবহিত করা হতো এবং জেল কর্তৃপক্ষ যদি সাংবাদিকদের পরিষ্কার করে বলত যে, রাত সাড়ে ১০টায় ফাঁসি কার্যকর হবে, তাহলে গণমাধ্যমকে ওই অসুস্থ ব্রেকিংযুদ্ধে নামতে হতো না।
তবে এ কথা ঠিক যে, সবকিছু সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না। গণমাধ্যমকেই ঠিক করতে হবে, তারা ব্রেকিং নিউজের নামে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা জারি রাখবে কি না। কেননা, এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলতে থাকলে মানুষের সঙ্গে গণমাধ্যমের দূরত্ব বাড়বে এবং সাংবাদিকরা ক্রমেই মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে থাকবেন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম : জন আস্থার দোলাচল বইটি সম্পর্কে কয়েকজন সাংবাদিকের মন্তব্য :