www.muktobak.com

হিস না বুম?


 সৈয়দ আশফাকুল হক    ২ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ১:১৪    মতামত


 হিসস!

‘হিস’ শব্দ করে বাষ্পের প্রবাহটি বন্ধ হয়ে গেল। হাতলের ওপরের ঢাকনাটি পিছলিয়ে নিচে এসে বাতাস ঢোকার কিংবা বের হবার জায়গাটুকু বন্ধ করে দিলো। পরবর্তী ‘হিস’ আসার আগে পর্যন্ত সিল করা পাত্রটির ভেতরে বায়ুচাপ বাড়তে থাকল। সাধারণ রান্না প্রক্রিয়ার চেয়ে কম জ্বালানি আর সময় ব্যবহার করে, কয়েকবার ‘হিস’ শব্দ হতে হতেই খাবার রান্না হয়ে গেল। বায়ুচাপের সহজ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি তত্ত্ব থেকে ফরাসি পদার্থবিদ ডেনিস পাপিন আজ থেকে বহুবর্ষ আগে— ১৬৭৯ সালে প্রেশার কুকার আবিষ্কার করেছিলেন।

আজ, শতশত বছর পর প্রতিটি রান্নাঘরের আবশ্যকীয় উপকরণ হিসেবে বিবেচিত এই প্রেশার কুকার। যদি তাকে ‘হিস’ শব্দ করতে দেওয়া হয়, তাহলে তা আপনার জন্য চমৎকার কাজ করবে। আর যদি তা না করে গলা টিপে বন্ধ করতে চান এই হিস হিস-কে, তাহলে সে কেবল আপনার বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং রূপান্তরিত হবে এক ভয়ংকর ‘প্রেসার বোমায়’।

চাপে থাকতে কেউই পছন্দ করে না। কিন্তু, একই সঙ্গে এটা এড়ানোরও কোনো উপায় নেই। এই যে চাপ ব্যবস্থাপনা, আপাতঃ দৃষ্টিতে এই সহজ কাজটির ওপরই আসলে নির্ভর করে একজন মানুষের সফলতা বা ব্যর্থতা। এবং এই ফলাফলটি আসবে ‘হিস’ শব্দের মাধ্যমে, কিংবা বোমা বিস্ফোরিত হবার ‘বুম!’ শব্দের মাধ্যমে। ‘হিস’ শব্দটি শ্রুতিমধুর নয় কোনো দিক দিয়েই। কিন্তু, একে সহ্য করুন; আখেরে আপনারই ভালো হবে। সত্যি বলতে কী, ‘হিস’ শব্দটিই আপনাকে নিরাপদে রাখতে সক্ষম।

আমাদের যেকোনো পরিবারের কথাই ধরুন না। আমরা কি দেখতে পাই না মতের অমিল, অসন্তুষ্টি, ভিন্নমত কিংবা দৃষ্টিভঙ্গী, এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের ভিন্নধর্মী আচরণ? আমরা তর্ক করি, চিৎকার করি, ঝগড়া করি এবং কখনো কখনো কেঁদেও উঠি বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে। বেশ কয়েকবার বিরক্তিসূচক ‘হিস’ শব্দ করেই তবে আমরা সর্বসম্মত সমাধানে পৌঁছাতে পারি।

বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করলে, একটি সমাজ কিংবা রাষ্ট্র অনেকটাই প্রেশার কুকারের মতো। একটি রাষ্ট্রের সমগ্র জনগোষ্ঠী সব কিছুতে একমত হবে; এটি একটি উদ্ভট চিন্তা। আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন মানুষ, আমাদের রয়েছে নিজস্ব মতামত, চিন্তা-আকাঙ্ক্ষা এবং সেই মতগুলো প্রকাশের নিজস্ব ভঙ্গি।

রাষ্ট্র পরিচালনার সময় জনমানুষের মধ্যে দুঃচিন্তা, গোলযোগ, মতভেদ ও অসন্তুষ্টি জেগে ওঠা অবিসম্ভাবী। রাষ্ট্র নামক সিল করা পাত্রটির ভেতর চাপ সৃষ্টি হতে শুরু করে এবং ফলশ্রুতিতে পাত্রের ঢাকনা খুলে আসে। তখনই সময় হয় ‘হিস’ শব্দের মাধ্যমে এই বাষ্পচাপকে মুক্ত করে দেওয়ার। এভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভিন্নমতকে গ্রহণ করা হয় সাদরে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে জনজীবনকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়।

কিন্তু, যখন একনায়কতন্ত্র জেঁকে বসে কিংবা গণতন্ত্র সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে, তখন এই ‘হিস’ শব্দের প্রক্রিয়াটি শ্বাসরুদ্ধ হতে থাকে। গণতন্ত্রের রুগ্ন স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি শুধু বাংলাদেশেই ঘটছে না। সমগ্র বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি পরাজিত ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যের বরিস জনসন, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, তুরষ্কের তাইয়েপ এরদোয়ান, ব্রাজিলের জাইর বোলসোনারোর, চীনের শি জিনপিং, ফিলিপাইনের রদ্রিগো দুয়ার্তে, কম্বোডিয়ার হুন সেন কিংবা ভারতের নরেন্দ্র মোদিকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর মুক্ত সংবাদমাধ্যমের জন্য সময়টা মোটেও উপযোগী নয়।

‘হিস’ শব্দ করা এমন এক ধরনের মতবিরোধের প্রকাশক, যা ক্ষমতার সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠে বসে থাকা মানুষরা একেবারেই পছন্দ করেন না। তারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করে সব ধরনের মতবিরোধকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

নতুন নতুন আইন, প্রযুক্তি, জাতীয় নিরাপত্তা ও ভাবমূর্তির অজুহাত দেখিয়ে তারা ছাপাখানার স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ঢাকনা দিয়ে চেপে ধরার চেষ্টা করেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রমাগতই তারা সাফল্যের সঙ্গে রাষ্ট্র নামক সুবিশাল প্রেশার কুকারটিকে টিকটিক শব্দ করতে থাকা ‘প্রেসার বোমা’য় রূপান্তর করে ফেলেন; যেটি যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে।

প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের জায়গাগুলো ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে এবং ‘হিস’ শব্দ করার প্রক্রিয়াটিকে শ্বাসরুদ্ধ করা হচ্ছে। কার্যকর বিরোধী দলের মতামতগুলো এখন আর পথেঘাটে কিংবা সংসদে শোনা যায় না। মুক্ত সংবাদমাধ্যকে এখন অনেক ধরনের বাধার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ), মানহানির আইন, ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ধামাচাপা দেওয়ার অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা, এবং সঙ্গীর গুম হওয়ার সার্বক্ষণিক ভীতিকে পেরিয়েই কেবল তারা ছাপার অক্ষরে বা প্রতিবেদনে মানুষের ‘হিস’ শব্দকে তুলে ধরতে পারেন।

এককালের প্রাণবন্ত সুশীল সমাজের আজকের এই নীরবতা মূলত ক্ষমতাশালী ব্যক্তিগোষ্ঠী আর তাদের মোসাহেব-চাটুকারদের রুদ্র রোষের হাত থেকে বাঁচার জন্যই।

তবে এটাও সত্য যে, আমরা এখনো কিছু ‘হিস’ শব্দ শুনতে পাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে। স্বাভাবিকভাবেই, বাংলাদেশ থেকে বহু দূরের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা মানুষগুলোর কাছ থেকেই সবচেয়ে জোরালো হিসগুলো শোনা যায়। বাংলাদেশে থাকা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা এতদিনে অনুধাবন করেছেন যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাদেরকে জামানতবিহীন হাজতবাসের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

সৈয়দ আশফাকুল হকদ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক

লেখাটি ডেইলি স্টারের প্রিন্ট সংস্করণে  Opinion: Hiss or boom? নামে প্রকাশিত। পরে অনলাইনে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়  হিস না বুম? নামে । - মুক্তবাক




 আরও খবর