এক চাঁদনি রাত! ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের ওপর বসে আলাপ করছেন কয়েকজন স্বপ্নবাজ তরুণ। সবাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যাল’র শিক্ষার্থী। একই স্বপ্ন, অভিন্ন উচ্ছ্বাস ও অনুভূতি।
চলছে গণমাধ্যমে কীভাবে কাজ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা। বন্ধুদের আগ্রহও বেশ। রাতে আলোচনার পর, পরদিনই ঢাকায় যান সবাই পত্রিকার খোঁজে। সে সময়ে ইত্তেফাকসহ ৪টি ভাল পত্রিকা ছিল। সুযোগও পেলেন তাঁরা। সারা দিনের নিউজ, গল্প, কবিতা, ছড়া লিখতে শুরু করলেন। এরপর এক বন্ধুকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতেন পত্রিকা অফিসে সেগুলো দিয়ে আসার জন্য। তখন যাতায়াত ব্যবস্থা এতটা ভালো ছিল না। নয়ারহাট ফেরি পার হয়ে যেতে হতো। গুলিস্তান নেমে কখনো রিকসায়, কখনো পায়ে হেঁটে, এমনকি সময় সংরক্ষণের জন্য কখনো বা দৌড়ে যেতেন। গুলিস্তান, মতিঝিল, মগবাজার হয়ে ইস্কাটন।
এভাবে পর্যায়ক্রমে সবাই সংবাদ নিয়ে ঢাকায় যেতেন। পরদিন আবার পত্রিকা নিয়ে আসতেন। এমনিতেও কিছু পত্রিকা ঢাকার শিক্ষকরা নিয়ে আসতেন। পত্রিকার কালো পাতায় হাজারো সংবাদের সঙ্গে নিজের লেখা সংবাদ, নিজের নামটা ছাপা হলে আনন্দে মনটা ভরে উঠতো। জাবিসাসের চল্লিশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সময় এমন স্মৃতির কথা জানান সদ্য প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাশেদ আহমেদ আলী।
তিনি আরও জানান যে, এরপরই বন্ধুদের নিয়ে আলোচনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক সমিতি নিয়ে। তৈরী করেন নীতিমালাও। মোট ৭জন সাংবাদিক মিলে ১৯৭২ সালের এপ্রিলের ৩ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রথম সাংবাদিক সংগঠন ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’। সংক্ষেপে জাবিসাস হিসেবে পরিচিত। আল বেরুনী হলের পাশের ক্যান্টিনে কয়েকটি চেয়ার ও টেবিল নিয়েই যাত্রা শুরু হয় জাবিসাসের।
প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের পরিসংখ্যান বিভাগের রাশেদ আহমেদ আলী নিজে এবং সাধারণ সম্পাদক হন দ্বিতীয় ব্যাচের অর্থনীতি বিভাগের আবুল কাশেম।
রাশেদ ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে সেই মানুষটির উদ্যোগটা আজ পঞ্চাশ বছরে পা দিতে যাচ্ছে। শনিবার এক অনলাইন স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্ত হয়েছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবুল কাশেম। জাবিসাসের নবীন-প্রবীনের মেলায় সবার বিশেষ আকর্ষণের মধ্যমনি ছিলেন কাশেম ভাই।
তিনি জানান, জাবিসাস প্রতিষ্ঠার সময় আরও যুক্ত ছিলেন আশরাফ মাহমুদ ইকবাল, আব্দুর রব, মতিউল আলম। পরে যুক্ত হন কবি নির্মলেন্দুগুনের অনুজ শৈবালেন্দু গুন, গোলাম আব্বাস হেলাল, আ. ক. ম রফিকুল হক, ইসলাম শরীফ সহ আরও অনেকে। যাদের আন্তরিকতা, কর্মনিষ্ঠা আর উদ্যমের ফলে আজকের এই জাবিসাস। তৎকালীন ভিসি ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। যিনি নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন বলে জানান তিনি।
উচ্চ শিক্ষার আলো আর গবেষণা মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়ে ১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বছর খানেক পরেই পথচলা শুরু জাবিসাসের। শত বাধা বিপত্তি মাড়িয়ে পথ চলার এ যাত্রার এবার পঞ্চাশে পা দিতে যাচ্ছে।
৫০ বছর বা অর্ধশতাব্দী মহাকালের হিসাবে কিছু কম হলেও একটি সংগঠনের জন্য তা অনেক বেশি। এই সময়ে একটি বৃক্ষ চারা যেমন পত্র পল্লবে, ফুলে-ফলে বিকশিত হয় তেমনি পরিনত বয়সে পৌঁছেছে জাবিসাস।
এর সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বর্তমানে দেশের উল্লেখযোগ্য গণমাধ্যমসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে সাংবাদিকতা পেশা বাদেও দেশে বিদেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনেকে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু নয় বরং সবর্ত্র একটি রীতি রয়েছে হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ‘নিজেদের নেতিবাচক বিষয়গুলো উপস্থাপন করা যাবে না। এতে মানহানি ঘটবে-লোকে খারাপ বলবে। বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা মিথ ভেঙে সাহসের সাথে সত্যকে তুলে ধরেছে সাংবাদিকরা। তাঁরা বারবার প্রমাণ করেছে, ‘সত্য যত তিক্তই হোক, তা বলাই শ্রেয়’।
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত জাবিসাসের ইতিহাস পুরোদস্তুর ‘আপোষহীনতার ইতিহাস’। মাথা উঁচু করে চলার ইতিহাস। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন, সর্বশেষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনে জাবিসাসের আপোষহীন এবং বস্তুনিষ্ঠ অবস্থানের কারণেই পত্রিকার পাতায় ওঠে এসছে প্রকৃত ঘটনা। এই পথচলায় নানা ঘাত প্রতিঘাত সত্ত্বেও জাবিসাস বজায় রেখেছিল তার পেশাদারিত্ব ও ন্যায়সঙ্গত অবস্থান। বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষার্থে ক্যারিয়ার ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তুলে ধরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণের কথা। নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তবুও থেমে যান নি।
সাংবাদিক সংগঠন হিসেবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে জারি রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি। যার অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করেছেন ‘সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার’। প্রত্যেক বছর সেরা অনুসন্ধানী সংবাদগুলো দেশসেরা সাংবাদিকদের বিচারের ভিত্তিতে পুরস্কৃত করা হয়। আর্থিকভাবে সম্মানিত করা হয়।
সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাবিসাস ছিল সর্বদায় সোচ্চার। যে কোন সংকটে এর অবস্থান থাকে চোখে পড়ার মত। কোন সাংবাদিক আক্রান্ত হলে প্রতিবাদের ঝড় তুলে পাশে দাড়ায় সংগঠনটি। সকল হুমকি ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দলমত নির্বিশেষে জাবিসাস হয়ে উঠেছে সাংবাদিকদের গ্রহণযোগ্য ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। যেন মরুভূমির বুকে বটবৃক্ষের ন্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল দল, মত নির্বিশেষে সকলকেরই বাতিঘর হিসেবে কাজ করে সংগঠনটি।
সূচনালগ্ন থেকে সংগঠনটি পরিচালিত হয়ে আসছে গণতান্ত্রিক ধারায়। এই পর্যন্ত ৪০টি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়েছে সদস্যদের ভোটে। যা দেশের ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা ও নেতৃত্ব বাছাইয়ে অনন্য নজির।
জাবিসাস আসলে একটি প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করে। যেখানে সংবাদ চর্চার পাশাপাশি, খেলাধুলা, আনন্দভ্রমণের আয়োজন করে থাকে। দক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক তৈরিতে সাংবাদিকতার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন হয়। যেখানে দেশি ও বিদেশি মিডিয়ার নামকরা সাংবাদিকরা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
সংস্কৃতিমনা ও প্রগতিশীল মানুষ তৈরির অনন্য মঞ্চ হিসেবে কাজ করছে সংগঠনটি। যার ধারায় জাহাঙ্গীরনর পরিচিতি পেয়েছে সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে। এখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। এখানে বছরজুড়েই থাকে শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার নানা অনুষ্ঠান। সাংবাদিকরা এ অনুষ্ঠানগুলো আন্তরিকতার সাথে সংবাদ মাধ্যমে উপস্থাপন করে।
জাবিসাস তার শুরু থেকেই সবকিছুর উপরে পেশাদারিত্বকেই প্রাধান্য দিয়েছে। কোন এজেন্ডা সৃষ্টি কিংবা বাস্তবায়ন নয় বরং সংগঠনটির কার্যক্রমে ফুটে উঠেছে সততার সাথে সত্যকে তুলে ধরার দীপ্ত প্রয়াস। পড়াশুনার পাশাপাশি সংগঠনটির প্রত্যেক সদস্য এখনও ‘সাদাকে সাদা’ বলার সংগ্রামটুকুই করে যাচ্ছেন। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অকপটে বলছেন নানা অনিয়মের কথা। পার করেছেন আপোষহীনতার ৪৯ টি বছর। মাথা উঁচু করে সগৌরবে পা দিচ্ছেন পঞ্চাশে। জয়তু জাবিসাস।
*মো. আসাদুজ্জামান, সাবেক সভাপতি, জাবিসাস