www.muktobak.com

সংবাদের সূত্র যাচাই কেন দরকারি?


 কদরুদ্দীন শিশির    ১১ মার্চ ২০২২, শুক্রবার, ১২:০১    ক্রসচেক


গত রাতে ফ্যাক্ট চেকার এক ছোট ভাই কয়েকটা খবরের লিংক ইনবক্স করে বললো, ভাই একটু পড়ে দেখিয়েন! পড়তে শুরু করলাম।


বাংলাদশের একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের শিরোনাম: "পুতিনকে নরক দেখাতে তৈরি মিস ইউক্রেন"।
খবরে বলা হয়েছে: "পুতিনের বাহিনীকে শায়েস্তা করতে ইউক্রেনের আরও অনেক বেসামরিক নাগরিকের মতো আনাস্তাসিয়াও এখন সশস্ত্র। যোগ দিয়েছেন ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে।"
আনাস্তাসিয়াও একজন ইউক্রেনিয়ান মডেল সুন্দরী প্রতিযোগী।

এই খবর আরও নানান ধরনের 'ইমোশনাল' শিরোনামে বাংলাদেশের মূলধারার বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া কেউ বাদ যায়নি! বেশিরভাগই পড়লাম। (ইতোমধ্যে ফেসবুকের থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট চেকাররা সেটি ডিবাঙ্ক করেছেন এবং দেশি সংবাদমাধ্যগুলো খবরটি সরিয়েছে বা সংশোধন করেছে)।
তো কয়েকটি প্রতিবেদন পড়ে দুই ধরনের সূত্র পেলাম খবরটি। কিছূ দেশি সংবাদমাধ্যম ভারতের এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস এর বরাত দিয়েছে। আবার কিছু রিপোর্ট বরাত দেয়া হয়েছে 'নিউইয়র্ক পোস্ট' এবং স্কাই নিউজ এর।
প্রথমে এডিটিভির ওয়েবসাইটে গেলাম। খবরটি পড়লাম। এরপর একে একে ভারতীয় ১০টার মতো সংবাদমাধ্যমে খবরটি পড়ে নিলাম। টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং আরও আরও।
সবাই বলেছে, আনাস্তাসিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেনিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।
ভারতীয় সবারই সূত্র স্কাই এবং নিউইয়র্ক পোস্ট।

এবার গেলাম স্কাই ও এনইউ পোস্টের রিপোর্ট পড়তে।
পোস্টের শিরোনাম: "Former Miss Grand Ukraine joins fight against Russian invasion" আর স্কাই তাদের রিপোর্টে লিখেছে: "Anastasia Lenna, who represented her country in the 2015 Miss Grand International beauty contest, has signed up to defend her home from Russian forces."
https://perma.cc/F8LX-KPLF
https://perma.cc/J8RM-YAR5

অর্থাৎ, ''ইউরোপ-আমেরিকার মিডিয়া''ও (উদ্ধরণ কমার মধ্যে রেখেছি এটা!) বলছে, দেশপ্রেমে আর্মিতে যোগ দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফাইট দিতেছেন!
এই দুই সংবাদমাধ্যমে দেখলাম তাদের সূত্র হলো ওই বেচারির ইনস্টাগ্রামের পোস্ট ও ছবি।
মূল ঘটনা হচ্ছে, ২২ ফেব্রুয়ারি যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়নি, কিন্তু উভয়পক্ষের যুদ্ধ যুদ্ধ একটা উত্তেজনার বিরাজ করছিল, ওই মডেল ইনস্টাগ্রামে নিজের একটা ছবি পোস্ট করে যেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি একটি রাইফেল হাতে একশন মুডে দাঁড়িয়ে আছেন। সাথে ক্যাপশন দিয়েছেন: ''#standwithukraine, #handsoffukraine''

perma

এরপর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পরে নানান সময়ে ইউক্রেনের পক্ষে নানা কিছু পোস্ট করেছেন। যেমন এক পোস্টে লিখেছেন: “Everyone who crosses the Ukrainian border with the intent to invade will be killed!”
আরেকদিন লিখেছেন: “Our [Ukraine’s] army is fighting in such a way that NATO should apply for entry into Ukraine.”
এসব পোস্টের রেফারেন্স আর ওই একশনের মুডের ছবি, যা যুদ্ধ শুরুর ২ দিন আগে পোস্ট করেছিলেন, সেগুলো খুটে খুটে জমা করে স্কাই এবং পোস্ট উপসংহার টেনেছে যে, "ইউক্রেনিয়ান সুন্দরী আর্মিতে যোগ দিয়ে বন্দুক হাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফাটিয়ে দিচ্ছেন"।

কিন্তু খেয়াল করলাম, তার যেসব পোস্টের লিংক দেয়া হয়েছে এবং ছবির কথা বলা হয়েছে সেগুলোর কোথাও সুন্দরী নিজে বলেন নি যে তিনি আর্মিতে যোগ দিয়েছেন বা বন্দুক হাতে রাশিয়াকে ফাটাচ্ছেন।
তো, আরেকটু দেখার জন্য তার ইনস্টা প্রোফাইলে ঢু মারলাম। চোখে পড়লো ২৮ ফেব্রুয়ারির একটি পোস্ট (তার দুই দিন আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম নিউইয়র্ক পোস্ট তার যুদ্ধে যোগদানের খবর দেয়)।
সেই পোস্টে বিস্তারিত অনেক কিছূই লিখেছেন আনাস্তাসিয়া।

প্রথম কয়েকটি বাক্য হলো: "I AM NOT A MILITARY, JUST A HUMAN. Due current situation I want to talk! I am not a military, just a woman, just normal human.
Just a person, like all people of my country. I am also a airsoft player for years. You can Google what #airsoft means.
All pictures in my profile to inspire people. I had a normal life just on Wednesday, like millions people. I don’t do any propaganda except showing that our woman of Ukraine - strong, confident and powerful."।

মোদ্দা কথা হলো, তিনি জানাচ্ছেন যে, তিনি মিলিটারির কেউ নন। মানে আর্মিতে যোগ দেননি। যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে তিনি কথা বলতে (প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন) শুধু। এবং আরও জানিয়েছে, তিনি তার ওয়ালে যেসব ছবি পোস্ট করেছেন সেগুলো শুধই মানুষকে উতসাহ দেয়ার জন্য করেছেন। সরাসরি বন্দুকের কথা উল্লেখ না করে তিনি জানিয়েছেন তিনি একজন এয়ারসফট খেলোয়াড়। আর এয়ারসফট কী সেটা জানার জন্য গুগল করতেও পরামর্শও দিয়েছেন!

গুগল করে দেখলাম- এয়ারসফট হইলো একধরনের খেলা যেখানে প্লাস্টিকের বন্দুক ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ফাইট টাইট করা হয়। এগুলোর নানান সংস্থাও আছে। এই খেলায় ব্যবহৃত বন্দুককে এয়ারসফট গান বলা হয়।
মানে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন!

খেলনা বন্দুক হাতে পোজ দেয়া আর ভিন্ন কয়েকটি পোস্টে রাশিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলা- এগুলো একসাথে মিলিয়ে 'আর্মিতে যোগ দিয়ে রাশিয়াকে সাইজ করার' তথ্য উতপাদন করেছেন একজন সাংবাদিক। এবং এরপর দেশি-ভারতদেশি নামকরা সংবাদমাধ্যমগুলো সেই সাংবাদিকের প্রতিবেদনকে কপি/অনুবাদ করে খবর আকারে প্রচার করলেন। কেউ একবারের জন্যও খবরের যে মূল সূত্র সেই নারীর ইনস্টাগ্রামে ঢু মারার প্রয়োজন বোধ করলেন না! কারণ ওখানে গেলেই দেখা যেত তিনি কোথাও তার আর্মিতে যোগ দান ও ফাইটের তথ্য দেননি।
এই ঘটনা থেকে একটা জিনিস শিখতে পারেন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা। নিজের দেশের, আশপাশের দেশের এবং বিশ্বের পরিচিত সংবাদমাধ্যমগুলোর আইডোলোজিক্যাল স্ট্যান্ডপয়েন্ট কী সে সম্পর্কে ধারণা নিয়ে রাখা। অথবা যে সংবাদমাধ্যম থেকে খবরটি নিচ্ছেন সেটির কার্যক্রমের ওপর কিছু বেসিক ধারণা নেয়া। এবং এরপর ডিসাইড করা ওই সংবাদমাধ্যমের বায়াস যে ইস্যুগুলোতে থাকতে পারে সেগুলো সংক্রান্ত খবর ওই সংবাদমাধ্যম থেকে বিনা যাচাইয়ে প্রকাশ না করা।

এনইউ পোস্ট বা স্কাই নিউজ এদের আইডোলোজিক্যাল অবস্থান খ্রিষ্টান রাইট উইং এবং ইউরোপিয়ান জাতীয়তাবাদী এবং সমাজতন্ত্র বিরোধী। ফলে রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধে এরা ইউক্রেনের পক্ষে আর রাশিয়ার বিপক্ষে যাওয়া খবর আবিষ্কার করে বেড়াবে। এক্ষেত্রে সত্যমিথ্যার চেয়ে পক্ষবিপক্ষে বড় তাদের কাছে। ফলে এই ইস্যুতে এসব সংবাদমাধ্যমের খবর এড়িয়ে অধিকতর পেশাদার পশ্চিমা আউটলেটগুলোর খবর অনুসরণ করা যেতে পারে।

এ ঘটনা নিয়ে পলিটিফ্যাক্ট এর রিপোর্ট পড়ুন এখানে: https://www.politifact.com/factchecks/2022/mar/07/facebook-posts/no-former-ukrainian-beauty-queen-has-not-joined-uk/?fbclid=IwAR3y2HjzWEn5X_z73eRAqJLd_y41pLRzusL4xzDfFPnad4nB8oA14du_vzQ


বুম বাংলাদেশ এর রিপোর্ট: https://www.boombd.com/.miss-ukraine-anastasia-lenna...

 

কদরুদ্দীন শিশির, ফ্যাক্টচেকার হিসাবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কর্মরত। 




 আরও খবর