www.muktobak.com

নিউজপ্রিন্ট সংকটে ভারতীয় সংবাদপত্র !


 শুভজিৎ পুততুন্ড    ১২ এপ্রিল ২০২২, মঙ্গলবার, ১১:১৭    আন্তর্জাতিক


যেকোনো সংবাদপত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিউজপ্রিন্ট বা সংবাদ ছাপার কাগজ। সম্প্রতি যে নিউজপ্রিন্টের ব্যাপক সংকটে ভুগছে ভারতের সংবাদপত্র গুলি। মহামারীর কারণে গেলো ২ বছরে তৈরি হয়েছিল সংকটের সূত্রপাত। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভারতের ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্ট, প্রেস কাউন্সিল এবং এডিটরস অ্যাসোসিয়েশন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছে এই সংকট আর কিছুদিন চললে দেশব্যাপী বন্ধ হয়ে যেতে পারে একাধিক সংবাদপত্র।

বিশ্বব্যাপী নিউজপ্রিন্ট সংকটের মধ্যে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। ২০১৯ করোনা মহামারীর সময় থেকেই পর পর একাধিক কারণে নিউজপ্রিন্ট নিয়ে সংকটে পড়েছে বিশ্বের বড় অংশের সংবাদপত্র গুলি। নিউজপ্রিন্ট আমদানিকারক দেশ হিসেবে যার বৃহৎ প্রভাব পড়েছে ভারতের সংবাদপত্রেও। ১৫২টি ভাষায় ১ লক্ষের বেশি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ভারতে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে এই সব সংবাদপত্রই পড়েছে বিপাকে। ভারতের মোট নিউজপ্রিন্ট আমদানির ৪৫ শতাংশের বেশি নির্ভরশীল রাশিয়ার উপরে। রাশিয়ান যুদ্ধের পর রাশিয়ার রপ্তানিকারকরা বিভিন্ন বন্দরে তাদের নিউজপ্রিন্ট পৌঁছে দেওয়ার কাজ চালিয়ে গেলেও গেলেও যুদ্ধের আবহে গেলো একমাস জুড়ে একদিকে নিরাপত্তার অভাব অন্যদিকে মার্কিন ও ইউরোপিয়ান মুলুকে নিষিদ্ধ হবার ভয়ে রাশিয়ান সমুদ্র বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে রাজি হয়নি অধিকাংশ বিদেশি কার্গো জাহাজ। পাশাপশি সুইফট জটিলতায় নিউজপ্রিন্টের মূল্য পরিশোধ আটকে যাওয়ায় রাশিয়ান নিউজপ্রিন্ট লোডিংও আটকে গিয়েছে ভারতীয় কার্গো জাহাজ গুলিতে।

ভারতের নিউজপ্রিন্ট রপ্তানিকারক অন্য দুই দেশ কানাডা এবং ফিনল্যান্ড। সাধারণ নিউজপ্রিন্ট ছাড়াও শুধুমাত্র গ্লসি নিউজপ্রিন্টের প্রায় ৬০% ভারতে আমদানি করা হয় ফিনল্যান্ডের নিউজপ্রিন্ট কোম্পানি ইউপিএম (UPM)থেকে। কানাডা থেকেও ভারতে আমদানি করা হয় সাধারন নিউজপ্রিন্টের প্রায় ৪০ শতাংশ। যুদ্ধের বেশ আগেই জানুয়ারি মাস থেকে ফিনল্যান্ডের ইউপিএমে শ্রমিক ধর্মঘট এবং প্রায় একই সময় কানাডায় ট্রাক চালকদের দীর্ঘ ট্রাক ধর্মঘটের জেরে ভারতে নিউজপ্রিন্ট আমদানির সাপ্লাই চেনে বড়োসড়ো প্রভাব পড়ে। এরমধ্যে যুদ্ধের আবহে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি কারণে এই দুই দেশের সাপ্লাই চেইন স্বাভাবিক হওয়ার বদলে থমকে গিয়েছে অনেকটাই।

যদিও নিউজপ্রিন্ট সংকটের শুরুটা হয়েছে কোভিড মহামারীর হাত ধরেই। মহামারী সময় অন্য সব শিল্প এবং সব সেক্টরের মতোই প্রভাবিত হয়েছে বিশ্বের ছোট বড় সংবাদপত্র গুলি। মহামারী ফলে দীর্ঘ লকডাউন এর কারণে বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল স্কুল কলেজ থেকে অফিস-আদালত। এই সময় নিউজ প্রিন্টের অন্যতম কাঁচামাল নষ্ট ও পুরনো কাগজ পুন:ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়। অন্যদিকে বিগত দু বছরেও স্বাভাবিক হয়নি গ্লোবাল লজিস্টিক সাপ্লাই, কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হতেই দেখা দিয়েছে ব্যাপক কার্গো কন্টেনারের কমতি। ঠিক এই সময়ের মধ্যে সমুদ্র মারফত কার্গো শিপিং খরচ বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। সংবাদপত্রর ছাপার রঙের দামও ঊর্ধ্বমুখী। তবে কাঁচামাল সংকটে নিউজপ্রিন্টের মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে রকেট গতিতে। ২০১৯ সালে ভারতে প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট আমদানি করার খরচ পড়তো ৪৫০ ডলার। যেখানে ২০২২ সালে নিউজপ্রিন্টের প্রতি টনের এর দাম দাঁড়িয়েছে ৯৫০ ডলার।

এমন সময় ভারতের দেশীয় নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনকারী সংস্থা গুলির মাধ্যমে সংকট সামাল দেওয়ার পরিস্থিতি নেই ভারতে। ভারতে নিউজপ্রিন্ট তৈরির খরচ রাশিয়া, ফিনল্যান্ড বা কানাডার তুলনায় তুলনায় অনেকে বেশি। স্বাভাবিক নিয়মে দেশে নিউজপ্রিন্ট ব্যবহারকারী সংস্থাগুলি হয়ে উঠেছে বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভর। ফলে তিন দশক আগে থেকেই ভারতে একে একে ঝাপ পড়েছে ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা অধিকাংশ বৃহৎ দেশীয় নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনকারী সংস্থা গুলোতে। অস্তিত্ব রক্ষায় অনেক সংস্থা নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনে বন্ধ করে মনোযোগী হয়েছে প্রিন্টিং এবং প্যাকেজিং সেক্টরে। কম দামে আমদানিনির্ভর ভারতীয় বাজারে অসম প্রতিযোগিতার কারনে দেশে নতুন করে এই সময়ের মধ্যে তৈরি হয়নি বৃহৎ কোনোও নিউজপ্রিন্ট শিল্পও।

কলকাতার প্রথম সারির "বর্তমান" পত্রিকার পাবলিশার জীবনানন্দ বসু সমকালকে বলেন "নিউজপ্রিন্ট সংকটে পত্রিকা চালানো দুস্কর হয়ে উঠেছে। হাতে স্টক থাকলেও যুদ্ধ কতদিন চলবে জানিনা তাই তিনগুণ দামে নিউজপ্রিন্ট অর্ডার করতে হয়েছে। ২৪ পাতা ২২ পাতার কাগজ ১৬ পাতায় নামিয়ে আনতে হয়েছে কখনও কখনও ১২ পাতা করতে হচ্ছে। পাতার সঙ্কটে খবরের কনটেন্ট এর সঙ্গে আপোস করতে হচ্ছে। এমনকি বিজ্ঞাপন ফেলে দিতে হচ্ছে।" ভারতের সংবাদপত্রের যৌথফোরাম এবং প্রেস কাউন্সিল গেল শনিবার এক বিবৃতি জারি করে এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। দ্রুত সমাধান হিসেবে ভারতে নিউজপ্রিন্ট আমদানির উপর ভারত সরকারের আরোপিত ৫% কাস্টমস ডিউটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন ফোরামের সদস্যরা।

লেখক : সাংবাদিক ও চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের ভারতীয় প্রতিনিধি




 আরও খবর