www.muktobak.com

মৃত্যুর মধ্য দিয়েও শিরিন আমাদের আশা জাগিয়ে রাখছেন


 জালাল আবুখাতের    ১৫ জুন ২০২২, বুধবার, ১১:১৭    আন্তর্জাতিক


দায়িত্বরত অবস্থায় গত ১১ মে পশ্চিম তীরের জেনিনে গুলিতে নিহত হন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ। জোরালো অভিযোগ উঠেছে, ইসরায়েলি সেনার ছোড়া গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন আল–জাজিরার এই সাংবাদিক। যদিও ইসরায়েল অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন শিরিন। তাঁর হত্যাকাণ্ডের এক মাস পূর্তিতে আল–জাজিরায় একটি নিবন্ধ লিখেছেন জেরুজালেমের বাসিন্দা জালাল আবুখাতের। লেখাটি অনুবাদ করেছেন হাসান ইমাম।

সবার প্রিয়ভাজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ হত্যার এক মাস পার হলো। জেনিন শহরে ইসরায়েলি সেনার গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।

এই হত্যাকাণ্ডের একটা মাস পেরিয়ে গেলেও আমরা ফিলিস্তিনিরা এটা মেনে নিতেই পারছি না যে শিরিন আর আমাদের সঙ্গে নেই; আমাদের লড়াই–সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন জোগাতে তিনি আর আমাদের মধ্যে কোনো দিন উপস্থিত থাকবেন না; কোনো দিন আর আমরা শুনব না রিপোর্টিং শেষে তাঁর সেই দারুণ উচ্চারণে বিদায় নেওয়া— ‘শিরিন আবু আকলেহ, আল–জাজিরা, ফিলাস্তিন’।

একদিকে তাঁকে (শিরিন) হারানোর অপরিসীম ক্ষতি ও শোক সামলে ওঠার চেষ্টা করছি, অন্যদিকে তাঁর মৃত্যুর খবর শোনার মুহূর্ত থেকে নিজেকেই বারবার প্রশ্ন করছি: আমরা কি শিরিন হত্যার ন্যায়বিচার পাব?

এক মাস পর, দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তর ধ্বনিত হচ্ছে ‘না’ বলে।
প্রকৃতপক্ষে, শিরিনের জন্য ন্যায়বিচার ততটাই দূরে, যতটা দূরে দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলের পদ্ধতিগত ও খুনে সহিংসতার শিকার যেকোনো একজন ফিলিস্তিনির জন্য ন্যায়বিচার। কিন্তু এর মানে এই নয় যে কোনো আশা নেই। আশা আছে।
শিরিনের হত্যাকাণ্ড যেভাবে ফিলিস্তিনিদের ঘর ছেড়ে পথে সমবেত করেছে, এমনটা আগে দেখা যায়নি।

ফিলিস্তিনির সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, শিরিনের শেষকৃত্যের আয়োজন ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ। প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তিন দিন ধরে তাঁর জন্য শোক করেছে মানুষ। অধিকৃত সন্ত্রাসকবলিত ফিলিস্তিন ভূমির প্রতিটি কোণ থেকে মানুষ জেগে উঠেছে; তাঁরা শিরিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। ন্যায়বিচার দাবি করছে।

শিরিন ছিলেন জেরুজালেমের মেয়ে, ফিলিস্তিনের মেয়ে। তিনি তাঁর গোটা জীবন কাটিয়েছেন এই ভূমির সত্যগাথা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে। এমনকি মৃত্যুর মধ্য দিয়েও তিনি আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে গেলেন। স্বাধীনতা, মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের প্রতিজ্ঞা আরও সুদৃঢ় হলো।

না, আমাদের মধ্যে কেউ এমনটা আশা করে না যে শিরিনকে হত্যার কথা ইসরায়েলি বাহিনী স্বীকার করবে বা এর ক্ষতিপূরণ দিতে উদ্যোগী হবে। আমরা এতটা নাবালক নই যে এ কথা বিশ্বাস করব, শিরিনের সঙ্গে যা করা হয়েছে, ফিলিস্তিনের জনগণের সঙ্গে যা করা হয়েছে, সে জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।

কিন্তু শিরিনের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ও তাঁর হত্যায় বিচার চেয়ে সংহতির বিষয়টি এই আশা জাগাচ্ছে, দখলদার ইসরায়েলের সব নির্মমতা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা তাদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য, স্বাধীনতার জন্য একসঙ্গে আছে, একসঙ্গে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

যেমনটা অনুমিত ছিল, হয়েছেও তা–ই। গত ১১ মে সকালে জেনিনে যা হয়েছে, সে ব্যাপারে প্রথমেই মিথ্যা বলেছে ইসরায়েল এবং এরপর তদন্ত পর্যন্ত করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা। অথচ আমরা সবাই জানি, কীভাবে ঠান্ডা মাথায় দায়িত্বরত অবস্থায় একজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। আর ইসরায়েল বলছে, ‘রাজনৈতিক জটিলতা থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি’র কারণে শিরিন নিহত হয়েছেন।

অথচ এ ব্যাপারে একাধিক ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের ভাষ্য, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা আমরা পেয়েছি; অনেক ভিডিওতে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং অসংখ্য বিশেষজ্ঞও বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা সবাই একমত যে, ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতেই শিরিন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত বারংবার বিশ্লেষণ করে, সম্ভাব্য সব দিক খতিয়ে দেখে এবং ঘটনাস্থলে পর্যবেক্ষণ করে (কোন দিকে, কত দূরত্ব থেকে বুলেট ছোড়া হয়েছে) সিএনএন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, শিরিনকে ‘লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে’ খুন করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।

কিন্তু বিশ্বের কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণই ইসরায়েলের প্রপাগান্ডা মেশিন থামানোর জন্য যথেষ্ট নয়। ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন চালানোর, ঘটনাকে বিপথে পরিচালিত করার অভিযান জারি রেখেছে ইসরায়েল। এই পরিস্থিতিই বাস্তবে যা ঘটে থাকে, তাকে আলোয় আসতে দেয় না। এমনকি শিরিন ইসরায়েলি সেনাদের বুলেটে নিহত হওয়ার ঘটনাতেও তারা এমন প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে, যাতে মনে হবে কোনো না কোনোভাবে ফিলিস্তিদের দোষেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

ইসরায়েলি জনগণও এসব মিথ্যাকে বিশ্বাস করে। অথবা অন্তত তাদের এটা মেনে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যে, রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে এমনটা করতে হয়েছে। এমনকি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ‘পেপার অব রেকর্ড’–এও দাবি করা হয়েছে, ‘শিরিনের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী, সে ব্যাপারে বিশ্ব এখনো খুব কমই জানে।’

অবশ্যই এসব মিথ্যা। বিশ্ব জানে তাঁর মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী। ইসরায়েলও জানে। এবং এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, আমরা ফিলিস্তিনিরা জানি, শিরিনের মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী।
শিরিনকে খুন করেছে ইসরায়েল। তিনি তাঁর কাজের জন্য খুন হয়েছেন। তিনি খুন হয়েছেন কারণ, একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি ফিলিস্তিনের কথা তুলে ধরছিলেন। তাঁকে খুন করা হয়েছে কারণ, তিনি দখলদার ইসরায়েলিদের বর্বরতার শিকার জেনিনের বাসিন্দাসহ অন্য ফিলিস্তিনিদের জন্য আওয়াজ তুলেছিলেন।

হয়তো খোলা চোখে কোনো ন্যায় চোখে পড়ছে না। কিন্তু মৃত্যুর মধ্য দিয়েও শিরিন আমাদের আশা জাগিয়ে রাখছেন। তাঁর আদর্শ আমাদের শক্তি জোগাচ্ছে লড়াইয়ের জন্য। তাঁর স্মৃতি ফিলিস্তিনজুড়ে আরও আরও সাংবাদিক তৈরি করার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে, যাতে করে এই সাংবাদিকেরা ইসরায়েলের দখলদারত্বের কুৎসিত দিক উন্মোচন করতে পারেন। বলাই বাহুল্য, শিরিনের জীবনেরও লক্ষ্য ছিল তাই।
গত ১১ মে শিরিনকে হত্যার পর কেবল অধিকৃত পশ্চিত তীরেই ১২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছে রামাল্লার আল–বিরেহ এলাকার ১৮ বছরের থাইর আল–ইয়াজোওরি, জেনিন শরণার্থী শিবির ১৭ বছরের আমজাদ আল–ফায়েদ, নাবলুস শহরের ঘাইথ ইয়ামিন (১৬)। বেথলেহেমে হত্যা করা হয়েছে ১৫ বছরের জাইদ ঘানিমকে। রামাল্লার কাছে আল–মিদ্যা গ্রামের ওদেহ ওদেহকে (১৭) হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
নামের তালিকা এই জন্য দিচ্ছি যে, শিরিনের মতো ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারানো এই কিশোর–তরুণদেরও ন্যায়বিচার প্রাপ্য।

আবারও বলছি, ন্যায়বিচারের বিষয়টি হয়তো দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে না, কিন্তু শিরিন হত্যাকাণ্ডের পর যেভাবে মানুষের মধ্যে আলোড়ন দেখা দিয়েছে, তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও সংহতি দেখা যাচ্ছে এবং যেভাবে ইসরায়েলি বুলেটে ফিলিস্তিনিদের প্রতিটি প্রাণহানির ঘটনা প্রতিরোধকে আরও সুদৃঢ় করছে, তাতে ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি এখন আরও বেশি বিশ্বাসী।

কিছু মিডিয়া এমন দাবিও করছে, শিরিন হত্যার এক মাস পর ফিলিস্তিনের অবস্থা এখন ‘তুলনামূলক শান্ত’। কিন্তু এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ইসরায়েলের নির্দয় দখলদারির নিচে ফিলিস্তিনিদের জীবন কখনো ‘তুলনামূলক শান্ত’ হতে পারে না।

শিরিনের জন্য, ইসরায়েলের নির্বিচার সন্ত্রাস প্রতিরোধে প্রাণ হারানো সবার জন্য আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সেই দায়িত্ব হলো সত্য তুলে ধরার, লড়াই জারি রাখার।

লেখাটি প্রথম আলো অনলাইন হতে নেয়া হয়েছে। আল জাজিরার মূল ইংরেজি লেখাটির জন্য ক্লিক করুনOne month on, still no justice in sight for our beloved Shireen

 




 আরও খবর