রানা আইয়ুব
৮ই নভেম্বর রাত আনুমানিক ১টা ২০ মিনিটে গভীর ঘুমের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ আমার ভাগ্নি ফোনের অবিরাম রিংয়ের শব্দে আমাকে জাগিয়ে তোলে। সে ফোনটি হাতে দিয়ে বলল, "কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।" মনে হচ্ছিল যেন আমার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে হিমবাহ ধ্বসে পড়েছে। ভিডিও কল, ভয়েস কল, টেক্সট মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ—ফোন যেন জ্বলে উঠেছে। আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, মেসেজগুলো আসতেই থাকল। একটি মেসেজে লেখা ছিল, "তোমার নম্বর ফাঁস হয়ে গেছে।"
আমি দ্রুত পাশের টেবিলে থাকা বিটা ব্লকার নিয়ে হৃদস্পন্দনের গতি কমানোর চেষ্টা করি এবং আমার ভাগ্নিকে বলি মাকে জাগাতে। হোম লোন কোম্পানি, ব্যাংক, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট, পর্ন ওয়েবসাইট, অনলাইন শপিং, রিয়েল এস্টেট প্রজেক্টসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাসওয়ার্ড ও একবারের ভেরিফিকেশন কোড আসতে থাকে। মেসেজগুলো কখনও যৌনতা, কখনও মৃত্যুর হুমকি, কখনও নিছক কৌতূহলের।
একজন বন্ধু আমাকে জানায়, ডানপন্থী একটি টুইটার হ্যান্ডল '@HinduphobiaWatch' আমাকে ডক্স করেছে এবং লোকজনকে হরর ফিল্মের লিঙ্ক পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে। অনেক ডানপন্থী হ্যান্ডল মজা করে তাদের "কর্তব্য" করার কথা জানায়।
আমি আমার ফোন বন্ধ করে দেই। এটা ছিল আমার অফিসিয়াল নম্বর। আমি সঙ্গে সঙ্গে ডক্সিং সম্পর্কে টুইটারকে রিপোর্ট করি, তারা বিষয়টি অগ্রাধিকারে দেখার আশ্বাস দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাইনি।
পরদিন আমি মুম্বাইয়ের বান্দ্রা-ওরলি কমপ্লেক্সে সাইবার ক্রাইম বিভাগে যাই। পুলিশরা প্রথমে বলে অভিযোগটি তাদের অধিকারভুক্ত নয়, পরে বাধ্য হয়ে অভিযোগ নেয়। এরপর স্থানীয় থানায় যাই এবং প্রায় ১১ ঘণ্টা বসে থেকে কল, মেসেজ, ও ভয়ানক হুমকির বিস্তারিত দিই।
আমি পুলিশের সাথে বসে অভিযোগ দিচ্ছিলাম, তখনও আমার ফোনে কল এবং মেসেজ আসতেই থাকে। এর মধ্যেই ভারতের অন্যতম প্রধান ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট ‘অল্ট নিউজ’ একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারা জানায়, যে ব্যক্তি আমাকে ডক্স করেছে এবং টুইটারে আমাকে নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করেছে, সে ভারতের শাসকদল বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারের সাথে যুক্ত।
এই তদন্তে ওই ব্যক্তির নাম, কর্মস্থল এবং পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়। পুলিশরা আমাকে জানায়, তারা এই প্রতিবেদন পড়েছে এবং এমন তদন্তে সময় লাগে। পরের দিন আমি মুম্বাইয়ের একটি আদালতে হাজির হই, যেখানে ২০০৯ সালে একটি ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন এবং তাদের একটি সন্ত্রাসী হামলায় সংশ্লিষ্টতা নিয়ে লেখা একটি নিবন্ধের জন্য আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হয়।
এটাই একমাত্র মামলা ছিল না। একই সপ্তাহে আমি উত্তর ভারতের আরেকটি মামলায় জামিন নিতে আদালতে হাজির হই, যেখানে মুম্বাইতে রাত ৮টায় আমার বাড়িতে পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে আসে। অথচ তখন আমি টরন্টোতে একটি আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়েছিলাম।
এদিকে, @HinduphobiaWatch টুইটার হ্যান্ডলটি আমাকে নিয়ে ঘৃণা ও ভুয়া তথ্য ছড়াতেই থাকে। তারা একটি ফটোশপ করা টুইট পোস্ট করে, যেখানে লেখা ছিল "আমি ভারত এবং ভারতীয়দের ঘৃণা করি।" এরপর তারা আরও বিকৃত তথ্য এবং পুরোনো ভিডিও পোস্ট করে, যা থেকে বোঝানো হয় যে আমি হিন্দুদের ঘৃণা করি।
এই পুরো ঘটনা চলাকালে আমি পুলিশের কাছে সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্টগুলো পাঠিয়ে যেতে থাকি এবং টুইটারে রিপোর্ট করি। কিন্তু কোনো প্রতিকার মেলেনি। আমি ডক্সিং-এর বিরুদ্ধে মামলা দাখিল করতেই এক হিন্দু জাতীয়তাবাদী আইনজীবী দিল্লি পুলিশের কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন। তিনি দাবি করেন, আমি ভারতে হিন্দু-বিরোধী ঘৃণা ছড়াচ্ছি এবং এর প্রমাণ হিসেবে ওই একই ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করেছেন, যা @HinduphobiaWatch শেয়ার করেছিল।
এরপর আরও খারাপ ঘটনা ঘটে। আমার ফোন নম্বর ফাঁস হওয়ার পর এবার আমার ইমেইল পাসওয়ার্ড, পাসপোর্টের স্ক্যান, বাড়ির ঠিকানা এবং ভিসার তথ্যও শেয়ার করা হয়। একটি টুইটার হ্যান্ডল আমার পাসওয়ার্ডের সাথে একজন আমেরিকান লেখকের নাম যুক্ত করে প্রশ্ন তোলে, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী।
একটি এআই জেনারেটেড ডিপফেক পর্ন ইমেজ শেয়ার করা হয়, যা ভাইরাল হয়ে যায়। এই ছবি শেয়ারকারী টুইটার হ্যান্ডলটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুসারী বলে পরিচিত।
আমি টুইটারে রিপোর্ট করলেও তারা জানায়, এটি তাদের প্রাইভেসি পলিসি লঙ্ঘন করেনি। ভারতে নারীদের চরিত্রের ওপর যে প্রচুর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, সেখানে আমাকে একটি ডানপন্থী ইকোসিস্টেমের শিকার বানানো হয়েছে।
এই ডানপন্থী ইকোসিস্টেমের সদস্যরা আমার সাংবাদিকতা ও অর্জনগুলোকে যৌনকরণের মাধ্যমে অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। তারা প্রশ্ন তুলছে, কতজন পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে আমি সফল সাংবাদিক হয়েছি। কেউ কেউ বলছে, আমি কর্মকর্তাদের "হানি ট্র্যাপ" করেছি তথ্য সংগ্রহের জন্য।
যখন এই ঘটনা ঘটছে, তখন একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী আইনজীবী দিল্লি হাইকোর্টে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অভিযোগ, আমি হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত করেছি। এই অভিযোগের ভিত্তি সেই একই ভুয়া তথ্য এবং বিকৃত টুইট, যা আগে ডক্সিং-এর সময় ছড়ানো হয়েছিল।
এর মধ্যেই, আমার এআই-জেনারেটেড পর্ন ইমেজ এবং ব্যক্তিগত তথ্যগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। আমার বিরুদ্ধে একটি ভার্চুয়াল লিঞ্চ মব দাঁড় করানো হয়েছে, যারা আমাকে জাতীয়-বিরোধী হিসেবে দেখছে। তারা আমার পরিবারের, এমনকি আমার সাত বছরের ভাতিজার ছবি পর্যন্ত বিকৃত করেছে। একবার একজন পুলিশ অফিসারকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমার মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, "যদি সরকার বদলায়, তখন হয়তো অপরাধীদের গ্রেপ্তার হতে দেখবেন।"
এই হয়রানি এবং ব্যক্তিগত জীবনে আঘাত কেবল কিছু অরাজনৈতিক ব্যক্তি দ্বারা হচ্ছে তা নয়। আমি এখন অন্তত পাঁচটি ভিন্ন মামলার বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমার ইমেলে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সমন বা নোটিশ আসে। যখন দরজায় ঘণ্টা বাজে, তখন আমার মনে হয় হয়তো পোস্টম্যান কোনো কাগজপত্র নিয়ে এসেছে, অথবা পুলিশ আবার কোনো পরোয়ানা নিয়ে এসেছে।
ভারত এখন বিশ্বে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা সূচকে ১৫৬তম স্থানে রয়েছে। রিপোর্টার্স সানস ফ্রন্টিয়ার্স (আরএসএফ) এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে আমার সাইবার হয়রানির ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।
দুই মাস আগে মণিপুরে একটি রিপোর্টিং ট্রিপে গেলে সেখানেও পুলিশ কর্মকর্তারা আমাকে নজরদারি করে। "কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস" একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যেখানে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, আমাকে মণিপুরে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অনুসরণ করেছিল।
এই ট্রিপে, স্থানীয় সাংবাদিকদের মতে, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আমার থাকার জায়গায় এসে উপস্থিত হন এবং পুরো সময় আমাকে অনুসরণ করেন। এমনকি একটি বিদ্যুৎবিহীন গ্রামের টয়লেটেও আমাকে অনুসরণ করা হয়। বাধ্য হয়ে আমি তাদের দিকে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেখিয়ে বেরিয়ে আসি।
মণিপুর বিমানবন্দরে একজন কর্মকর্তা আমাকে লুকিয়ে ভিডিও করছিলেন। আমি তার ফোন কেড়ে নিয়ে দেখি সেখানে আমার ভিডিও রয়েছে। তার ব্যাজে লেখা ছিল "স্টেট ইন্টেলিজেন্স"। তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ক্ষমা চান এবং চলে যান।
এই ঘটনার প্রতিটি অংশ আমাকে মনে করিয়ে দেয়, একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি কতখানি ঝুঁকিতে আছি। ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য যেখানে ন্যায়বিচার একটি দুর্লভ বিষয়, সেখানে একজন মুসলিম মহিলা সাংবাদিক হিসেবে আমি একাধিক পরিচয়ের কারণে নির্যাতিত।
ভারতে সাংবাদিকতা করার সময় আমি যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমার মুসলিম পরিচয়। আমার কাজকে অন্যান্য সাংবাদিকদের মতো নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখা হয় না। বরং আমাকে আমার ধর্মের ভিত্তিতে দেশবিরোধী হিসেবে দেখা হয়।
এমন একটি দেশে, যেখানে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা দ্রুত বাড়ছে, সংখ্যালঘুদের ওপর প্রকাশ্যে হামলা হয়, এবং মুসলমানরা তাদের নিজস্ব "জিম ক্রো" মুহূর্ত পার করছে, আমি বুঝতে পেরেছি যে, নারী, মুসলিম, এবং একজন সরকার-বিরোধী সাংবাদিক হিসেবে আমার পরিচয়গুলো আমাকে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করেছে।
আমি যেসব প্রতিবেদন তৈরি করেছি, সেগুলোতে বরাবরই প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজ আমার নিজের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ছে। আমার রিপোর্টিংকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিশ্বাসঘাতকতার নজির হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সাংবাদিকরা বলতেই ভালোবাসেন যে, তারা কখনোই "কাহিনির অংশ" হতে চান না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে, আমি নিজেই যেন কাহিনির কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছি।
এই পরিস্থিতির মধ্যে, আমার কাজের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা এবং সাহস দুটোই প্রশ্নের মুখে পড়ে। আমি কি সত্যিই এমন একটি দেশে রিপোর্ট করতে পারি, যেখানে প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলো আমার মতো নারী সাংবাদিকদের হয়রানির পথ সহজ করে দিয়েছে? যেখানে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় অপরাধীরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়?
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে গেলে এরকম কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। ভারতের মতো দেশে সাংবাদিকদের জন্য কাজ শুধু চ্যালেঞ্জিং নয়, কখনো কখনো এটি মানসিক, সামাজিক, এবং পেশাগত জীবনকেও ধ্বংস করে দিতে পারে।
একই সঙ্গে, এটি শুধু ভারতের গল্প নয়। বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই সাংবাদিকদের ওপর এমন আক্রমণ বেড়েছে। সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আজ বিশ্বব্যাপী একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
'গুজরাট ফাইলস' খ্যাত সাংবাদিক রানা আইয়ুবের নিজের ওয়েবসাইটে 'How does a journalist report in Modi's India?' শীর্ষক লেখাটি মুক্তবাকের পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। -মুক্তবাক
