গাজার সত্য প্রকাশ হোক

বিশ্ব

দি ইন্ডেপেন্ডেন্ট-এর সম্পাদকীয়

(২ মাস আগে) ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার, ৫:৩৬ অপরাহ্ন

talktrain

“যুদ্ধে সবার আগে নিহত হয় সত্য।” গ্রিক নাট্যকার এস্কাইলাসের দুই হাজার বছরের পুরোনো এই উক্তিটি আজও করুণ বাস্তবতা। বিশেষত গাজার রক্তাক্ত সংঘাতের প্রেক্ষাপটে।

আজ বিশ্বজুড়ে ২০০–এরও বেশি সংবাদমাধ্যম, সংবাদমুক্তির সংগঠন ও অধিকারকর্মী—যেমন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF) ও কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (CPJ)—একযোগে আহ্বান জানিয়েছে: বিদেশি সাংবাদিকদের অবিলম্বে এবং বাধাহীনভাবে গাজায় প্রবেশাধিকার দিতে হবে।

কারণ স্পষ্ট। পৃথিবীকে জানতে হবে এবং বুঝতে হবে গাজার দুর্ভোগের প্রকৃত ব্যাপ্তি। জানতে হবে কীভাবে সেখানে জীবন ধ্বংস হচ্ছে, এবং সে সত্যকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।

ইতিমধ্যে যুদ্ধ ও বোমাবর্ষণে প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। অনেক সময় সন্দেহজনক পরিস্থিতিতেও। তারা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, অথচ তাদের একা এমনটা করা উচিত ছিল না। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদেরও স্বাধীনভাবে সংবাদ সংগ্রহ, অনুসন্ধান ও যাচাইয়ের সুযোগ থাকা উচিত ছিল।

কিন্তু ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বারবার পেশাদার ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে “হামাস–সংযোগ” থাকার অভিযোগ তুলে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। অথচ বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার এর চেয়ে বড় কারণ আর কী হতে পারে —যাদের হামাস বা অন্য কোনো ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্ক নেই। যাতে তারা এসে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারেন এই নির্মম, অন্তহীন যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র।

ইসরায়েল দাবি করছে, বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য গাজা যুদ্ধক্ষেত্র বিপজ্জনক। এ কথার মধ্যেই ভয়াবহ বিদ্রূপ আছে। অভিযোগ রয়েছে, ইসরায়েলি সেনাদের কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই সাংবাদিকদের টার্গেট করছে। খান ইউনুসের নাসের মেডিকেল সেন্টারে ইন্ডিপেনডেন্ট আরাবিয়া-এর সহকর্মী মরিয়ম আবু ডাক্কা ও আরও চারজন নিহত হওয়ার ঘটনা তার সাম্প্রতিক প্রমাণ। প্রথম হামলার নয় মিনিট পর দ্বিতীয় আঘাতে নিহত হয়েছিলেন অনেকে—যারা আহতদের বাঁচাতে ছুটে গিয়েছিলেন। ইসরায়েল এটিকে তদন্তাধীন বলছে, আর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কেবল “দুঃখজনক ভুল” বলে পাশ কাটিয়ে গেছেন।

আসলে গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের নির্বিচার ও অসম কর্মকাণ্ডই একে সবার জন্য বিপজ্জনক করে তুলেছে। ঘোষিত “নিরাপদ অঞ্চল” আসলে নিরাপদ নয়, আর সেগুলো ঘনঘন পরিবর্তিত হওয়ায় মানুষ শুধু গৃহহীন নয়, হয়ে পড়েছে অবস্থানহীন— এমন এক ভূখণ্ডে, যেখানে কোথাও প্রকৃত নিরাপত্তা নেই।

সুতরাং গাজা বিপজ্জনক, এতে সন্দেহ নেই। তবে সাংবাদিকরা যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করার ঝুঁকি নেবেন কিনা, সেই সিদ্ধান্ত কেবল তাদের। কোনো দখলদার শক্তির নয়। তবু স্পষ্ট বোঝা যায়, ইসরায়েল চায় না বিশ্ব জানুক গাজায় কী ঘটছে। যদি তাদের সাধ্য হতো, তারা হয়তো সব সাংবাদিকতাই বন্ধ করে দিত। কিন্তু স্মার্টফোনের যুগে তা আর সম্ভব নয়।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সাংবাদিকের জীবন অন্য কারও জীবনের চেয়ে মূল্যবান নয়। তবে মূল্যবান হলো সত্য, এবং সেই সত্য খুঁজে বের করার অধিকার। এজন্য সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী অযোদ্ধা হিসেবে সুরক্ষা দিতে হবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

যাই হোক, গাজায় বিদেশি সংবাদমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত অর্থহীন। একদিন, দেরিতে হলেও, সত্য প্রকাশ পাবেই। সাংবাদিকেরা যখন ধ্বংসস্তূপে প্রবেশ করবেন, তারা আবিষ্কার করবেন জীবনের এবং জীবিকার নিঃশেষ ধ্বংস। সেসব দৃশ্য হবে ভয়াবহ, অনেক সময় প্রকাশের অযোগ্য। যেমনটা হয়েছিল ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর হামাসের নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার পর— যখন ইসরায়েল নিজেই সেই ভয়ঙ্কর সত্য প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিল। তখনকার মতো এখনো সত্য প্রকাশ জরুরি।

সত্য তখন প্রকাশ করা সঠিক ছিল, এখনো তাই সঠিক।

বিশ্ব থেকে আরও পড়ুন

সর্বশেষ