
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় চলমান গণহত্যার অংশ হিসেবে গত ১৪ মাসে ১৯৬ জন সাংবাদিককে খুন করেছে ইসরাইল। তবে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) গত ১৬ ডিসেম্বর তাদের এক প্রতিবেদনে কিছুটা কমিয়ে দেখিয়েছে এই সংখ্যাটা। তাদের হিসাব অনুযায়ী নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৩৩ জন। তবে ক্রমবর্ধমান সাংবাদিক হত্যায় জড়িত ইসরাইলকে দায়মুক্তি দেওয়ার পশ্চিমাদের চেষ্টার নিন্দা করেছে সংগঠনটি।
সিপিজে জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহেই চারজন সাংবাদিককে হত্যা করেছে ইসরাইল। নিহতরা হচ্ছেন আহমেদ আল-লুহ, মোহাম্মেদ বালোসা, মোহাম্মেদ আল ক্রিনাবি ও ইমান আল-শান্তি। ইসরাইলি বাহিনী তাদের সরাসরি টার্গেট করে হত্যা করে। আল-ক্রিনাবি ও আল-শান্তির সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদেরও পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। গাজার সাংবাদিকদের টার্গেট করে হত্যার ইসরাইলি পরিকল্পনার সর্বশেষ ঘটনা এগুলো।
মোহাম্মেদ বালোসার হত্যাকাণ্ডটিকে এমনভাবে সাজিয়েছে ইসরাইল, দেখে মনে হবে যেন এটি একটি দুর্ঘটনা। তিনি গাজার সেই সাংবাদিকদের একজন, যারা সেখানের আল-নসর হাসপাতালে ইসরাইলি হামলায় অপরিণতভাবে জন্ম নেওয়া শিশুগুলোর কোমল ছোট্ট দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশ করেছিলেন। এক বছর আগেও তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল ইসরাইলি সেনারা। সে সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার আর ঘাতকদের নিশানা থেকে রক্ষা পাননি তিনি।
গত সপ্তাহে ইসরাইলি হত্যাকাণ্ডের শিকার চার সাংবাদিকের একজন আল-লুহর হত্যার ঘটনা নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে উল্লেখ করেছেন ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত আমেরিকান সাংবাদিক মরিয়ম বারঘুতি। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘গাজায় প্রতি ৫০ ঘণ্টায় একজন করে সাংবাদিককে হত্যা করছে ইসরাইল।’ অন্যদিকে, সিপিজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উত্তর গাজায় দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকরা সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। সেখানে জাতিগত নির্মূল অভিযানের শিকার হচ্ছেন তারা, যাতে ওই এলাকার গণহত্যার খবর বাইরে না আসতে পারে।
গাজায় ইসরাইলের নৃশংসতার যে চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে এসেছে, তা সম্ভব হয়েছে স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রতিবেদনের কারণেই, যার বেশির ভাগই হামলায় নিহত হয়েছেন। তবে কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। অল্প যে কজন বেঁচে আছেন, তাদের মধ্যে হোসাম সাবাত, হিন্দ খোওদারি ও বিশান ওউদা এখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাজায় ইসরাইলি নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
গত নভেম্বর মাসের শেষ দিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি ‘গাজায় কোনো সাংবাদিক নেই’ বলে মন্তব্য করেন। তার এই মন্তব্য থেকে অন্তত দুটি বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রথমত, পশ্চিমা বিশ্বসমর্থিত সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে পরিচালিত গণহত্যার মাধ্যমে গাজার আদিবাসী গ্রুপগুলোকে সক্রিয়ভাবে নির্মূল করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ফিলিস্তিনিদের তাদের খবরের বিশ্বস্ত সূত্র হিসেবে গণ্য করে না। এ কারণে তারা তাদের মিডিয়ায় ও প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের কথা ভুলেও উল্লেখ করতে আগ্রহী নয়।
কোনো সন্দেহ নেই যে, গাজায় চলমান গণহত্যার মধ্যেই স্থানীয় সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ ও তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ১৯৬ জন নিহত ছাড়াও এ পর্যন্ত আহত হয়েছেন অন্তত ৪৯ জন সাংবাদিক, নিখোঁজ রয়েছেন দুজন। এ ছাড়া ইসরাইল অবৈধভাবে আটক করেছে ৭৫ সাংবাদিককে।
গাজা উপত্যকায় সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকাটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা এই পরিস্থিতি থেকেই বোঝা যায়। তারা নিজের জনগোষ্ঠীকে গণহত্যার শিকার হতে দেখছেন চোখের সামনে এবং তার বর্ণনাও তাদেরই লিখতে হচ্ছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। শুধু ফিলিস্তিনি হওয়ার কারণেই তারা নিজেরাও ইসরাইলি সেনাদের অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন। এমনকি সাংবাদিকতায় তাদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা ও নির্যাতন-নিপীড়নের চিত্র এবং অবদানকে চিরদিনের জন্য মুছে ফেলা হচ্ছে তাদের হত্যা করার মাধ্যমে। এই পরিস্থিতি যে কতটা হৃদয়বিদারক, তা শুধু ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
এটা খুবই লজ্জার কথা যে, গাজার এই পরিস্থিতিতেও পশ্চিমা বিশ্বের সাংবাদিকরা, বিশেষ করে নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, বিবিসি ও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের মতো মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার সাংবাদিকরা গাজায় তাদের সহকর্মীদের প্রতি ন্যূনতম সমর্থনও জানাচ্ছেন না। বরং তারা গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। এসব মিডিয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর পরিচালিত গণহত্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছে বরাবরই।
এই পরিস্থিতিতে ইসরাইল যে গাজার সাংবাদিকদের টার্গেট করে নির্মূল অভিযান চালাবে, তা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাংবাদিকদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও ত্রাণকর্মীদেরও নিজেদের কিলিং মিশনের টার্গেটে পরিণত করেছে ইসরাইল। ইহুদি বর্ণবাদী এই দেশটি এ কথা ভালো করেই জানে যে, গাজায় তারা যে জঘন্য অপরাধ করে যাচ্ছে, তার সাক্ষ্য-প্রমাণ ও চিহ্ন মুছে ফেলার কাজে পশ্চিমারা সব সময়ই তাদের পাশে রয়েছে।
গাজার সাংবাদিকদের ইসরাইল টার্গেট করে হত্যার ঘটনায় পশ্চিমা মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের নীরব থাকার কী ব্যাখ্যা আছে? অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া তাদের হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে গাজার সাংবাদিকদের। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় এ খবরটি সেভাবে আসেনি। এমনকি গাজায় সিপিজের হিসাব অনুযায়ী ১৩৩ জন সাংবাদিক নিহত হওয়ার খবরটিও কোনো গুরুত্ব পায়নি পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে। তাদের কাছে এটা কোনো খবরই মনে হয়নি।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু গাজার সাংবাদিকদের অবদান ও তাদের আত্মত্যাগের ঘটনাকে মুছে ফেলতে সহায়তা করে পশ্চিমা মিডিয়া ও রাজনীতিকরা ইসরাইলের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পথে বাধা সৃষ্টির মাধ্যম দেশটির দায়মুক্তির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে তারা গাজায় অস্ত্রবিরতির আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছেÑ এ ধরনের খবরের নামে গুজব ছড়িয়ে ইসরাইলের গণহত্যার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের খাদ্য, চিকিৎসাসংকট অব্যাহত রাখার পথ প্রশস্ত করতে বড় ভূমিকা রাখছে।
তবে পশ্চিমা মিডিয়া ও ক্ষমতাসীনরা গাজায় গণহত্যার চিহ্ন মুছে ফেলার ও সেখানের সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার যত চেষ্টাই করুক না কেন, আমরা সবকিছুই দেখছি, সব হিসাব ও তথ্য-প্রমাণ ঠিকই রাখছি। একদিন সময় আসবে যখন ইসরাইলি দখলদারিকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই সফল হবে না। সেদিন গাজার সাংবাদিকদের ঘাম, অশ্রু ও রক্ত কথা বলবে।
দ্য নিউ আরব থেকে অনুবাদ : মোতালেব জামালী
লেখাটি দৈনিক আমার দেশ থেকে নেওয়া। - মুক্তবাক