নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যম কী স্বাধীনতা ও দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে?

দেশ

মুহিদুল ইসলাম জুলকান

(১ মাস আগে) ২১ জানুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার, ৩:৩৫ অপরাহ্ন

talktrain

বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমের ভূমিকা এতটাই বিশাল যে তা কল্পনা করা কঠিন। এটি ভোটারদের এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে, ধারণাগুলোর আদান-প্রদান, স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকে উত্সাহিত করে।  

ন্যায্য এবং দায়িত্বশীল তথ্য সরবরাহ করা স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। তবে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়িত্বের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা জটিল।  

তথ্যের প্রধান উৎস হিসেবে গণমাধ্যম প্রার্থী, রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় বিষয়ে ভোটারদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে। বাংলাদেশের মতো বৈচিত্র্যময় নির্বাচনী এলাকায় কাজটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভোটারদের পছন্দ অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।  

গণমাধ্যম রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতার মধ্যে রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও। অনিয়ম যেমন ভোট জালিয়াতি, প্রতারণা বা দুর্নীতি প্রকাশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখানে বড় ভূমিকা পালন করে। এভাবে গণমাধ্যম গণতন্ত্রের মূল অংশ রক্ষা করে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার একটি পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া, গণমাধ্যম প্রান্তিক ও দূরবর্তী সম্প্রদায়ের ভোটারদের বিশেষভাবে সচেতন করতে পারে, যেমন প্রচারণা, ভোটার নিবন্ধন, ভোটগ্রহণ ও ভোটের তারিখ সম্পর্কে তথ্য প্রচার করে। এই ধরনের জনসেবামূলক বার্তা ও প্রচারণা ভোটার উপস্থিতি এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রকে উন্নীত করে।  

তবে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সামনে বিশেষ করে নির্বাচনী মৌসুমে চ্যালেঞ্জ কম নয়। একটি প্রধান ঝুঁকি হলো রাজনৈতিক পক্ষপাত। অনেক গণমাধ্যম নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করার অভিযোগে অভিযুক্ত, যা তথ্যকে পক্ষপাতমূলক করে এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। এই পক্ষপাতিত্ব ভোটারদের নিরপেক্ষ তথ্য পাওয়া কঠিন করে তোলে।  

আরেকটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হলো ভ্রান্ত তথ্য এবং গুজব। ডিজিটাল যুগে গুজব এবং তৈরি করা তথ্য ভাইরাল হয়ে যায় এবং সামাজিক মাধ্যম জনসাধারণের কথোপকথনকে ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের সময় এটি বিশেষভাবে বিপজ্জনক, কারণ ভুল তথ্য ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে পারে। গণমাধ্যমের উচিত সঠিক এবং যাচাই করা তথ্য জনগণের কাছে সরবরাহ করা।  

পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে, বাংলাদেশে গণমাধ্যম ক্রমশ দমনমূলক পরিবেশের সম্মুখীন হয়েছিল। অনুসন্ধানী ও সমালোচনামূলক প্রতিবেদন, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে, সাংবাদিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, হুমকি, আটক এবং এমনকি সহিংসতার ঝুঁকিতে ফেলেছিল। ভিন্নমত দমন করা হয়েছিল এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA), পরে সাইবার নিরাপত্তা আইন (CSA), এর মতো আইন ব্যবহার করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে দমিয়ে রাখা হয়েছিল।  

সাইবার অপরাধ মোকাবিলার উদ্দেশ্যে তৈরি হলেও, DSA ছিল সরকারপক্ষীয় মতকে সুরক্ষিত করার হাতিয়ার। সাংবাদিকদের এমন আইনের আওতায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল, যেখানে তাদের প্রতিবেদন বা পোস্ট কর্তৃপক্ষের কাছে "ক্ষতিকর" বলে মনে করা হয়েছিল। বাস্তবে, এটি সমালোচনামূলক কণ্ঠস্বর বন্ধ করতে ব্যবহার করা হয়েছে, ফলে ব্যাপক আত্মনিয়ন্ত্রণ/সেলফসেন্সরশিপ প্রথায় পরিণত হয়।  

তাছাড়া, সমালোচনামূলক প্রতিবেদনগুলো দমন বা মুছে ফেলা হয়েছে এবং সরকারপন্থী সংবাদ প্রচারিত করা হয়েছে। স্বাধীন বা বিরোধীপন্থী গণমাধ্যমগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা নিশ্চিত নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ন্যায়সংগত এবং স্বচ্ছ রাখতে বাধাগ্রস্ত করেছে।  

বাংলাদেশের গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে অবশ্যই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। প্রাথমিক পদক্ষেপটি হলো দমনমূলক আইন যেমন সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা বা পরিবর্তন করা এবং নিশ্চিত করা যে নতুন আইনগুলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করবে না।  

রাষ্ট্রের উচিত সাংবাদিকদের সুরক্ষা এবং তথ্য সরবরাহের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য একটি আইনি কাঠামো তৈরি করা। নির্বাচনী মৌসুমে বিশেষত হয়রানি বা মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে সাংবাদিকরা যাতে বাধাপ্রাপ্ত না হন, সেজন্য একটি উন্মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  

গণমাধ্যম-সম্পর্কিত প্রস্তাবিত আইনগুলো গৃহীত হওয়ার আগে তা পর্যালোচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ। CSA এবং DSA এর মতো আইনগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে যাতে তা বাকস্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ না করে। নতুন আইনগুলো গণমাধ্যমকে আরও শক্তিশালী, জবাবদিহিমূলক এবং স্বচ্ছতার পক্ষে কাজ করার সুযোগ দেবে।  

সরকারকে মিডিয়া সাক্ষরতা বাড়ানোর উদ্যোগও নিতে হবে। প্রচুর ভ্রান্ত তথ্যের যুগে ভোটারদের প্রয়োজন উপস্থাপিত তথ্য সমালোচনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা। মিডিয়া সাক্ষরতার উদ্যোগ জনগণকে সত্য ও মিথ্যা তথ্য চিহ্নিত করতে সহায়তা করতে পারে।  

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এটি উল্লেখ করে যে প্রতিটি নাগরিক তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং গণমাধ্যম তথ্য এবং ধারণাগুলো স্বাধীনভাবে প্রচার করতে পারে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি গণমাধ্যমকে সরকারের ওপর একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেয়।  

তবে, ৩৯ অনুচ্ছেদে যে স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি অবাধ নয়। এটি জনশৃঙ্খলা, শালীনতা এবং নৈতিকতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে পালন করতে হবে। সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য তৈরি এই সীমাবদ্ধতাগুলো মাঝে মাঝে সরকার-বিরোধী সমালোচনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে দমন করতে ব্যবহৃত হয়েছে।  

গণমাধ্যমকে হস্তক্ষেপমুক্তভাবে কাজ করতে হবে, তবে এটি অবশ্যই নৈতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে; তাদের সত্য, ন্যায্যতা এবং নিরপেক্ষতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। এই দায়িত্ব নির্বাচনের সময় আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পক্ষপাতদুষ্ট বা ভুল প্রতিবেদন জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কলুষিত করতে পারে।  

একটি মুক্ত গণমাধ্যম নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে এমন একটি আইনি পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যাতে সাংবাদিকরা কারাবাস, হয়রানি বা হুমকির ভয়ে কাজ করতে বাধাগ্রস্ত না হন। সাংবাদিকদের যাতে নির্বাচন-সম্পর্কিত বিষয়গুলিতে রিপোর্ট করতে কোনো আইনি বাধার সম্মুখীন হতে না হয়, সেজন্য আইনগুলো আপডেট করতে হবে।  

গণমাধ্যম খাতের মানোন্নয়ন হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র তার গণমাধ্যম পর্যবেক্ষককে পাবে, যা নাগরিকদের এবং ভোটারদের অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে সহায়তা করবে।  

গণমাধ্যম যেন এই ভূমিকা পালন করতে পারে, তার জন্য সরকারকে প্রথমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, দমনমূলক আইন বাতিল করতে হবে এবং নতুন আইন যেন বাকস্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত না করে তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।  

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা এবং দায়িত্বশীল প্রতিবেদনের বিকাশে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ নির্বাচন সমর্থন করবে।  
ইংরেজি দৈনিক টিবিএসে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ। - মুক্তবাক

দেশ থেকে আরও পড়ুন

সর্বশেষ