
গত ১৮ মাসে গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলায় প্রায় ২০০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ৪২ জন সরাসরি তাদের পেশাগত কাজের কারণে প্রাণ হারান। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে পশ্চিম তীরেও সাংবাদিকদের ওপর ইসরায়েলি দমন-পীড়ন বেড়ে যায়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী, উভয়ের নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা সাংবাদিকরা বর্তমানে ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার, বাধা এবং সহিংসতার সম্মুখীন হচ্ছেন। ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের অবস্থা নিয়ে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির অনুবাদ ৩ মে বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস উপলক্ষে মুক্তবাকের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।
মিডিয়া পরিস্থিতি
পেশাদার ও অপেশাদার সাংবাদিকরা গাজায় চলমান যুদ্ধ কভার করছেন। তাদের অনেকেই অবরুদ্ধ ও অবরোধের আওতায়া থাকা এলাকায় থেকে নিজ উদ্যোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে বিশ্বকে যুদ্ধকালীন জীবনের বাস্তবতা জানাচ্ছেন। তাঁরা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের জন্য কাজ করছেন। ফিলিস্তিনে বেশ কিছু স্বাধীন গণমাধ্যম, যেমন ওয়াতান টিভি, আজিয়াল রেডিও আছে, আবার ফাতাহ ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম, যেমন ফিলিস্তিন টিভি ও ওয়াফা সংবাদ সংস্থাও তাদের দায়িত্বপালন করছে।
এছাড়া গাজায় হামাসঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম হিসেবে পরিচিত শেহাব নিউজ এজেন্সি ও আল-আকসা মিডিয়া নেটওয়ার্ক কাজ করে। তবে সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণে সংবাদ উপস্থাপনার সুযোগ সীমিত।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
গাজা অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই সাংবাদিকদের জন্য সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে বিবেচিত। কেউ ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতার সন্দেহে হামাস বা ইসলামিক জিহাদের বাধার মুখে পড়েন, আবার ইসরায়েলি অবরোধ ও বিমান হামলাও জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে এই দমন-পীড়ন ও ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। যেসব সাংবাদিক হামাসের চাপ মোকাবিলা করেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তারা এখন ইসরায়েলি প্রচারযন্ত্রের লক্ষ্যবস্তু; কেননা তাদের বিরুদ্ধে হামাসের হয়ে কাজ করার অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
সাংবাদিকদের ওপর হুমকি, অপপ্রচার ও হামলা চলছে, এমনকি কয়েকজন ইসরায়েলি রাজনীতিক প্রকাশ্যেই গাজার সাংবাদিকদের শাস্তি দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।
আইনগত বাস্তবতা
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মৌলিক আইনে মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও, বাস্তবে তা সরকারের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের প্রণীত সাইবার অপরাধ আইন মতপ্রকাশ ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রুদ্ধ করেছে। গাজায় ২০০৭ সালের পর থেকে কোনো নতুন আইন তৈরি হয়নি।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা
গাজা অঞ্চলের অর্থনৈতিক দুর্দশা স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোর টিকে থাকা কঠিন করে তুলেছে। ৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলি বিমান হামলায় বেশিরভাগ টেলিযোগাযোগ ও মিডিয়া অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে, তবে গাজা এখনো অবরোধের আওতায় রয়ে গেছে। ইসরায়েল মানবিক সহায়তা বন্ধ করে তা চাপ প্রয়োগের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
৮০ শতাংশের বেশি গাজাবাসী; যার মধ্যে শত শত সাংবাদিকও আছেন। তারা সবধরনের সহায়তার সুযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাবুতে বসবাস করছেন। প্রায় কোনো মানবিক সহায়তা তাদের কাছে পৌঁছার সুযোগ নেই।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা
ধর্ম ও রক্ষণশীল চিন্তাধারার প্রভাব ফিলিস্তিনে সাংবাদিকতার ওপর স্পষ্ট। নারী সাংবাদিকরা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও প্রতিবন্ধকতার শিকার। তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, এই বিষয়গুলো এখন গৌণ হয়ে গেছে। পুরুষ ও নারী—সব সাংবাদিকই এখন বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত।
আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায়, এই সাহসী স্থানীয় সাংবাদিকরাই আজ বিশ্বের চোখ ও কান হয়ে উঠেছেন।
নিরাপত্তা পরিস্থিতি
২০২৪ সালে ফিলিস্তিন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ দেশ হয়ে উঠেছে সাংবাদিকদের জন্য। গাজায় প্রথম ১৮ মাসেই প্রায় ২০০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ৪২ জন নিহত হন পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়। শুধু চলতি বছরই ৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছে। এছাড়া আরও অনেক সাংবাদিক ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি।
গাজার সাংবাদিকেরা একেবারে আশ্রয়হীন, খাদ্য ও পানির অভাবে দিন কাটাচ্ছেন। পশ্চিম তীরে সাংবাদিকদের নিয়মিতভাবে ইসরায়েলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের হাতে হয়রানি ও হামলার শিকার হতে হয়। ৭ অক্টোবরের পর সাংবাদিকদের ওপর গ্রেপ্তার ও দমন-পীড়নের ঢেউ আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর অপরাধের বিচারহীনতা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
গতবছর ১৮০টি দেশের মধ্যে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ফিলিস্তিনের অবস্থান ১৫৭ হলেও এ বছর ১৬৩তে রয়েছে।