
ফারাজ
গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেনকে প্রথম আলো “বিপদে বন্ধুর পরিচয় দেয়া” একজন “সাহসী তরুণ” হিসাবে সংবাদ, কলাম, মতামত ও স্মৃতিচারণ প্রকাশ করে আসছে। ফারাজ ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান অর্থাৎ প্রথম আলোর মালিকের নাতি। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ুয়া ফারাজ ঘটনার দিন তার দুই বন্ধু অবিন্তা কবির ও তারুশি জৈনকে নিয়ে হোলি আর্টিজানে ছিলেন। জঙ্গি হামলায় তিনজনেরই মৃত্যু হয়।
প্রথম আলো প্রচারণা চালায় এই বলে যে, মুসলিম হওয়ায় জঙ্গিরা ফারাজকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু ফারাজ তাঁর বন্ধু অবিন্তা ও তারুশিকে ছেড়ে আসতে চাননি। আবার পশ্চিমা পোশাক পরায় অবিন্তা ও তারুশিকে ছাড়েনি জঙ্গিরা। তাই তিনজনকেই হত্যা করে তারা। ফারাজকে নিয়ে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর লিখা একটি কলামে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক লিখেছেন, “তিনি হয়ে ওঠেন হাজার বছরের ঈশপের উপদেশের জীবন্ত ধারক—বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। বিপদে প্রকৃত বন্ধু বন্ধুকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় না।”
প্রথম আলোর এই প্রচারণার মূল সূত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ২০১৬ সালের ২ জুলাই অর্থাৎ ঘটনার পরদিন প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে ফারাজের “ভাগ্নে” হিশাম হোসেনকে উদ্ধৃত করা হয়। বলা হয়, হিশাম “জিম্মিদশা থেকে ছাড়া পাওয়াদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন” যে “খুব ভোরে, বন্দুকধারীরা হিজাব পরা একদল মহিলাকে ছেড়ে দেয় এবং ফারাজ হোসেনকেও চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়। ইমরি ইউনিভার্সিটির ছাত্র জনাব হোসেন, পশ্চিমা পোশাক পরা দুই মহিলার সাথে ছিলেন। বন্দুকধারীরা যখন ওই মহিলাদের জিজ্ঞাসা করলেন তারা কোথা থেকে এসেছেন, তারা বলেছিলেন ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বন্দুকধারীরা তাদের ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং মিস্টার হোসেন তাদের ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন। শনিবার সকালে যাদের মৃত অবস্থায় পাওয়া যাবে তাদের মধ্যে তিনিও থাকবেন।”
হোলি আর্টিজানের ঘটনায় জিম্মি দশা থেকে পালিয়ে আসা বা ছাড়া পাওয়া ব্যক্তিদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের সাক্ষাতকার আমি নিজে নিয়েছি। তাঁদের কেউই বন্ধুদের ছেড়ে ফারাজের আসতে না চাওয়ার যে ঘটনার বর্ণনা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে উদ্ধৃত করে প্রথম আলো প্রচার করে আসছে তা দেখেননি। প্রথম আলোর অন্য কোনো রিপোর্টারও গত আট বছরে এমন কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান পাননি। পুলিশের তদন্তেও এমন কিছু উঠে আসেনি। অন্যান্য গণমাধ্যমের যেসব সাংবাদিক হোলি আর্টিজান নিয়ে সক্রিয়ভাবে রিপোর্ট করেছেন তাঁরাও এমন কোন ঘটনার বর্ণনা প্রকাশ করেননি। এমনকি প্রথম আলো নিজেও এই ঘটনা নিয়ে কোনো বিস্তারিত সংবাদ উপস্থাপন করতে পারেনি। পুরো বিষয়টি পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা করেছে কলাম, মতামত, ফারাজকে নিয়ে স্মৃতিচারনের সংবাদ প্রকাশ করে করে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ওই নিউজটিতে বাংলাদেশ থেকে তথ্য দিয়েছিলেন জুলফিকার আলি মানিক এবং মাহের সাত্তার। পরিচয় থাকায় জুলফিকার আলি মানিককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ফারাজকে নিয়ে এমন তথ্যের সত্যতা নিয়ে। তিনি বলেছিলেন সংবাদের ওই অংশটুকু তিনি পাঠাননি। মাহের সাত্তারের সাথে পরিচয় না থাকায় কখনো এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এই তথ্যের কোনো সত্যতা নেই এই কারণে যে জঙ্গিরা হোলি আর্টিজানে যাদের হত্যা করেছিলো তাঁদেরকে হামলার পরপরই হত্যা করে ফেলে, যা প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে প্রতিষ্ঠিত। সকাল পর্যন্ত নিহত হওয়াদের কেউই জীবিত ছিলেন না।
একটা ঘটনার পর পর অনেক ধরণের ভাষ্যই সামনে আসে। একাধিক সোর্স থেকে যাচাই বাছাই করে সত্য তথ্য তুলে ধরাটাই গনমাদ্ধ্যমের প্রধান কাজ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্যের অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহ এবং সিটিজেন জার্নালিজমের এই সময়ে মূলধারার গনমাদ্ধ্যমের যতটুকু গ্রহণযোজ্ঞতা আছে তার অন্যতম একটি কারণ তথ্য যাচাই বাছাইয়ে সাংবাদিকদের দক্ষতার কারণেই। আবারও বলছি, এক্ষেত্রে প্রথম আলো এবং তাঁর সংবাদকর্মীরা বাংলাদেশের যেকোনো গনমামাধ্যমের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি হোলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ফারাজকে নিয়ে যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছিলো তা অসত্য। পত্রিকাটি পরবর্তীতে এই বিষয়ে কোন সংশোধনও দেয়নি। আর ওই প্রতবেদনকে ভিত্তি করে ফারাজকে “বিপদে বন্ধুর পরিচয় দেয়া” একজন “সাহসী তরুণ” হিসাবে প্রথম আলো যেভাবে দিনের পর দিন প্রচারনা চালিয়েছে এবং এখনো যাচ্ছে তা অপসাংবাদিকতা। জেনে বুঝে পরিকল্পিতভাবে পত্রিকাটি এই ক্ষেত্রে ঘটনার অর্থাৎ ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছে। এবং সর্বপরি পাঠকের সাথে প্রতারণা করেছে।
চলবে...?
বিদ্র: প্রথম আলোতে আমি অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকতা করেছি ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত। তাই ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার দিন থেকে আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর “জঙ্গিবাদ বিরোধী” অভিযান এবং দেশে জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ে নিউজ করা শুরু করি। ২০২১ সালে চাকরি ছাড়ার আগ পর্যন্ত সেটা অব্যাহত ছিলো।
(লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে লেখাটি নেওয়া হয়েছে।- মুক্তবাক)