
এডওয়ার্ড এস হারম্যান এবং নোয়াম চমস্কির 'Manufacturing Consent' গ্রন্থের একটি বিখ্যাত উক্তি হলো: "A mass movement without any major media support, and subject to a great deal of active press hostility, suffers a serious disability, and struggles against grave odds."
এই উক্তি আমাদের চোখের সামনেই বাস্তবায়িত হয়েছে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং অন্যান্য আন্দোলনের সময়।
আমাদের প্রত্যাশিত মিডিয়া— যেখানে নিরপেক্ষতা, সত্যতা, এবং বৈচিত্র্যময় কণ্ঠের প্রতিফলন থাকবে, পাশাপাশি ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতার মধ্যে রাখা হবে — গত কয়েক বছরে এই মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
বর্তমানে, ক্ষমতায় আসার পর অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে, যার মধ্যে একটি হলো মিডিয়া সংস্কার কমিশন। এটি আমাদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করেছে গণমাধ্যম সংস্কার এবং আন্তর্জাতিকভাবে সফল সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত মিডিয়া মডেল নিয়ে আলোচনা করার।
যেমন নামটি থেকেই বোঝা যায়, সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত গণমাধ্যম বলতে এমন সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয় যা সাধারণত সরকারি অনুদান, লাইসেন্স ফি, সাবস্ক্রিপশন ফি বা বিশেষ করের মাধ্যমে জনগণের অর্থায়নে পরিচালিত হয়।
বিশ্বব্যাপী এই মডেলের সফল উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে বিবিসি (যুক্তরাজ্য), এবিসি (অস্ট্রেলিয়া), পিবিএস (যুক্তরাষ্ট্র) এবং আল জাজিরা (কাতার)। এসব প্রতিষ্ঠান পক্ষপাতহীন সংবাদ এবং এমন বিষয়বস্তু নিয়ে কন্টেন্ট সরবরাহ করে যা জনস্বার্থ রক্ষা করে।
তবে, বাংলাদেশের গণ অর্থায়নে পরিচালিত গণমাধ্যম যেমন বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) এবং বাংলাদেশ বেতার এই ধরনের সফলতার উদাহরণ নয়।
যদিও তত্ত্বগতভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত হওয়ার কথা, বাস্তবে তারা শাসক দলের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, জনগণ বিটিভি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কারণ পূর্ববর্তী সরকারগুলো এই চ্যানেলকে জনস্বার্থে কাজ করতে দেওয়ার পরিবর্তে কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় এজেন্ডা প্রচারের জন্য ব্যবহার করেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে দুর্নীতি। ফলে এই প্রতিষ্ঠানটি জাতির কণ্ঠস্বর হওয়ার পরিবর্তে নিজের অবস্থান হারিয়েছে।
বেসরকারি খাতে, বাণিজ্যিক চ্যানেলগুলো তাদের আর্থিক স্বার্থে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব চ্যানেল পরিচালিত হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায়। এর ওপর, সরকারের চাপের ফলে টেলিভিশন চ্যানেল এবং সংবাদপত্রগুলো স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার মানদণ্ড থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। ফলে "রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস"-এর ২০২৪ সালের বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম সূচকে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫তম অবস্থানে রয়েছে।
তবে, দেশ যখন নতুন পথে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে, তখন সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত গণমাধ্যমের ধারণাটি আবারো আকর্ষণীয় একটি প্রস্তাব হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এই ধারণাটি জনসেবার মূলনীতিতে ভিত্তি করে, যেখানে বাণিজ্যিক লাভের চেয়ে নিরপেক্ষ তথ্য, শিক্ষামূলক বিষয়বস্তু এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই মডেল কতটা কার্যকর হতে পারে?
সম্ভাব্য মডেল এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
বিবিসি (যুক্তরাজ্য), একটি রাজকীয় সনদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং সংবিধানগতভাবে স্বাধীন, গণমাধ্যমের জন্য একটি আদর্শ উদাহরণ হতে পারে। বিবিসি মূলত টেলিভিশন লাইসেন্স ফি দ্বারা অর্থায়িত হয়, যা যুক্তরাজ্যের বাড়িগুলো থেকে সংগৃহীত হয়, যারা সরাসরি টিভি দেখে বা বিবিসির "iPlayer" সেবা ব্যবহার করে।
এই মডেলটি বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে কার্যকরভাবে স্বাধীন থাকতে সাহায্য করে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহমেদের মতে, বিবিসির পুরনো 'ট্রাস্ট' মডেলটি বাংলাদেশের জন্য আদর্শ হতে পারে। এই মডেলটি বিবিসির ব্যবস্থাপনা এবং বাইরের সংগঠনগুলোর থেকে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতো, যেখানে লাইসেন্স ফি প্রদানকারীদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্য ছিল।
"বাংলাদেশে একটি 'ট্রাস্ট মডেল' কেমন হওয়া উচিত, তার জন্য আমাদের বিস্তারিত কাঠামো তৈরি আছে এবং এটি বাস্তবায়নে আমরা ব্যবহার করতে পারি," তিনি উল্লেখ করেন।
ক্রাউডফান্ডিং: বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা
একটি গণমাধ্যম পুরোপুরি ক্রাউডফান্ডিংয়ের উপর নির্ভর করে টিকে থাকতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অধ্যাপক আহমেদের মতে, "আমার জানা মতে, বিশ্বে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য গণমাধ্যম নেই যা শুধুমাত্র ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এটি একটি বাস্তবসম্মত মডেল নয়।"
তবে, সম্প্রতি বাংলাদেশি-আমেরিকান সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাফকাত রাব্বী ক্রাউডফান্ডিংয়ের ভিত্তিতে ইংরেজি ভাষার একটি সংবাদ চ্যানেল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তার এই প্রস্তাব ফেসবুকে বেশ আলোড়ন তুলেছে।
"আমি পোস্ট দেওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান অ্যাপল কর্মী আমাকে বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন," রাব্বী উল্লেখ করেন।
তিনি আরও জানান, এই প্ল্যাটফর্মটি প্রাথমিকভাবে ফেসবুক, এক্স (টুইটার) এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে পরিচালিত হবে। পরবর্তীতে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করা হবে, যা বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় স্থানেই নিবন্ধিত হবে।
যদিও এই উদ্যোগের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত, এটি একটি পরীক্ষামূলক মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
কীভাবে কাজ করবে? কোথায় সমস্যা হতে পারে?
সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত একটি গণমাধ্যম সরাসরি জনগণের দ্বারা অর্থায়িত হওয়ায় তাদের কাছে আরও বেশি জবাবদিহিতাপূর্ণ হতে পারে এবং বাণিজ্যিক বা রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমের তুলনায় বেশি স্বাধীন হতে পারে।
বেসরকারি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রায়ই রাজনৈতিক পক্ষপাত বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ উঠে। এ অবস্থায়, একটি সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত গণমাধ্যম পক্ষপাতহীন সংবাদ কভারেজের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। এছাড়া, বাণিজ্যিক স্বার্থের উপর নির্ভরতা কমানোর মাধ্যমে এটি একটি গণমুখী মডেল প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
তবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিবেচনায় নিয়ে, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দাতারা বা সাবস্ক্রাইবাররা কি প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করবেন? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
এছাড়া, সম্পাদনার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আরও একটি বড় বিষয়। শক্তিশালী আইনি সুরক্ষা ছাড়া, এই ধরনের প্রতিষ্ঠান সবসময় সরকার বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপের শিকার হতে পারে।
একটি গণমুখী গণমাধ্যম মডেল প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা, জনগণের সক্রিয় সমর্থন এবং আইনি সুরক্ষা। এগুলো নিশ্চিত করা গেলে, বাংলাদেশেও একটি স্বাধীন ও কার্যকর গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত Is a public-funded media outlet a viable option in Bangladesh? লেখাটির অনুবাদ। - মুক্তবাক