
২০১৭ সালের 'লাভেলো মিস বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতায় জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন দেশীয় কতিপয় সাংবাদিক 'গভীর অনুসন্ধান' করে পাঠক, দর্শককে জানান, ওই মেয়ের 'কুমারিত্ব' নেই! সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে 'কুমারিত্ব থাকা, অবিবাহিতা হওয়ার' শর্ত লঙ্ঘন, গোপন করেছেন এভ্রিল। তার আগের বিয়ের কাবিননামা, সাবেক স্বামীর সঙ্গে ছবি প্রচার, প্রকাশ করে 'হিট সাংবাদিক' হয়ে ওঠে ঢাকার একটা শ্রেণি।
পুরুষতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আগের বিয়ের তথ্য শুধু এভ্রিল নন, অনেক প্রতিযোগীই গোপন করেন। এমনকি কুমারী মা হয়েও প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে পরে মুকুট হারানোর উদাহরণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মারজেরি ওয়ালেস প্রথম বিশ্বসুন্দরী খেতাবজয়ী হওয়ার পর জানা যায়, তিনি পিটার রেভসন নামের একজনের স্ত্রী আর গায়ক টম জোনসের গার্লফ্রেন্ড৷ অভিনেত্রী লিওনা গেজ বিশ্বসুন্দরী হওয়ার পরে জানা যায়, তিনি দুই সন্তানের কুমারী মা৷ এর জেরে তিনি মুকুট হারান৷
সাংবাদিকদের অনুসন্ধান যে কোনো নারীর 'কুমারিত্ব', আগের বিয়ের কাবিননামার দিকে ধাবিত হতে পারে, এর প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করেছে ঢাকার কতিপয় প্রচারমাধ্যম। সিনেমার নায়িকা পরীমনির 'গ্রামে থাকাকালে হওয়া বিয়ের কাবিননামা' এভ্রিলের 'কুমারিত্ব অনুসন্ধানের' আগেই প্রচার, প্রকাশ করে বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। যে কোনো পেশার নৈতিকতা আক্রান্ত হলে সাংবাদিকরা প্রশ্ন তোলেন। অথচ নিজের পেশার নৈতিকতার বিষয়ে এ দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে একটা মূখ্য অংশের কোনো ধারণাই নেই। পেশা হিসেবে এটাই এ দেশে সাংবাদিকতার 'ট্র্যাজেডি'। নৈতিকতা বোধের অভাবে প্রায় সময়ই কোনো নারীর বিষয়ে রসালো কিছু লিখতে গিয়ে সাংবাদিকরা অজান্তেই নিজের 'ধর্ষকামী, পুরুষতান্ত্রিক' মনের চিত্র পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেন। এর সবশেষ নজির তারা প্রতিষ্ঠা করছেন সঙ্গীতশিল্পী তাহসান খানের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী রোজা আহমেদকে নিয়ে লেখালেখি, বলাবলিতে।
রোজার বাবা কে ছিলেন, তিনি আগে কয়টা প্রেম করেন, তার সাবেক প্রেমিকের অনুভূতি কী- এসব পড়ে, দেখে যে কারো মনে হতে পারে, চিন্তা-চেতনা, রুচির দিক থেকে সেসব সংবাদমাধ্যম একেবারে নিচু শ্রেণির! সামাজিক বোধ নামের কোনো কিছু মগজে জন্মানোর বুদ্ধিটুকু সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে দেননি। রোজাকে 'চরিত্রহীনা' প্রমাণ করতে নিজেদের 'জ্ঞান' জাহিরের কী নির্লজ্জ প্রয়াস তাদের! রোজার ব্যক্তিগত জীবন, জীবনযাপনের ধরন, কোন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক- এসব পাঠক, দর্শকের কাছে রগরগে বর্ণনায় উপস্থাপন তো চটি সাংবাদিকতা। এগুলো তার নিতান্তই নিজস্ব বিষয়। সংবিধানও তাকে এসবের অধিকার দিচ্ছে।
যে কোনো নারীর ব্যক্তিগত রুচি, জীবনবোধের প্রতি সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা, সম্মানবোধ থাকতে হয়। না থাকলে পেশার নৈতিকতা রক্ষা হয় না। কারো ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা জনসমাজে ছড়িয়ে দেয়া অন্যায়। কখনো কখনো কারো কারো নিজের ঘরে, বা পাশের বাড়ির রসুই ঘরে উঁকি দিলে যে ঘটনার দেখা পাওয়া যায়, তেমন কিছুর জন্য রোজার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে লজ্জাও হয় না আমাদের? রোজার মতো কি আমাদের কোনো বোন নেই?❞
হাসান শান্তনু : সাংবাদিক